বান্দরবান সদর উপজেলার রেইচা এলাকার গোয়ালিয়া খোলা গ্রাম। চারিদিকে সবুজ আর সৌন্দর্যের সমারোহ। শীতকালীন সবজি ভরপুর গ্রামের পর গ্রাম। জৈব সার দিয়ে এই সবুজ ফসলকে যিনি প্রাণবন্ত করে তুলতে কাজ করে যাচ্ছেন তিনি হলেন গোয়ালিয়া খোলা গ্রামের কৃষক আবুল বশর।
জেলা সদরের সুয়ালক,রেইছা বাজার, গোয়ালিয়া খোলা,রোয়াজা পাড়া,ধুঙ্গি পাড়া,রত্নপুর,লম্বা ঘোনা,সাতকমল পাড়াসহ বিভিন্ন এলাকায় মানুষ এখন কৃষি নির্ভর হয়ে পড়েছে। এখানে প্রতিটি পাড়ায় কম বেশি কৃষকের বসবাস। সম্প্রতি সময়ে এই এলাকার কৃষকেরা বান্দরবান কৃষি অধিদপ্তরে সহযোগিতায় আধুনিক চাষাবাদ সর্ম্পকে নানা প্রকার ধারণা নিয়ে কৃষিজ ফসল উৎপাদন করে যাচ্ছে ।
এই এলাকায় ফসল উৎপাদনের একটি অন্যতম সহযোগি উপাদন হল জৈব সার। কৃষক আবুল বশরের কাছ থেকে নায্যমুল্যে ক্রয় করে প্রতিটি কৃষক পরিবার এখন স্বাচ্ছন্দে নানা রকম সবজি উৎপাদন করে যাচ্ছে। এই সার ভর্মি কম্পোস্ট যা কেঁচো সার নামে ও পরিচিত।
বান্দরবান সদর ইউনিয়নের রেইচার গোয়ালিয়া খোলা এলাকায় সরজমিনে পরিদর্শনে দেখা যায়, জেলা শহরের কাছে আর সবচেয়ে বেশি সতেজ শাক সবজির উৎপাদন হয় বলে এই গ্রাম এখন সবজির গ্রামে পরিচিত হয়ে উঠছে। যাকে অনেকেই সবজির কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে মনে করছে। সবুজের সমারহ যেদিকে তাকায় সবুজ ফসলের মাঠ আর মাঠ।
আরো দেখা যায়, স্ত্রীসহ ৩ ছেলে সন্তান নিয়ে বসবাস করে এই আবুল বশর। বাড়ির আঙ্গিনার একপাশে নিম তৈল,জৈব সার,ভর্মি কম্পোস্ট,বালাইনাশক,টাইকো কম্পোস্টসহ নিজের উৎপাদিত বেশ কিছু সারের স্তুপ। এখানে যে সারটি আমার চোখে তাক লাগালো সেটি ভর্মি কম্পোস্ট।
আবুল বশর বান্দরবান কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও বান্দরবানের একটি বেসরকারি সংগঠনের (এনজিও) এর মাধ্যমে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ পেয়ে নিজেই ২০১৪ সাল থেকে কৃষি কাজের পাশাপাশি পরিবারের আঙ্গিনায় শুরু করেছে ভর্মি কম্পোস্ট (কেঁচো) সার তৈরি। তিনি জানান, জৈব সার আমাদের মাটি ও ফসলের জন্য খুবই গুরত্বপূর্ণ কারন আমরা যেভাবে কেমিক্যাল ব্যবহার করে মাটির প্রাকৃতিক র্উবরতা কমিয়ে ফেলেছি তাতে করে মাটির জন্য প্রাকৃতিক জৈব সার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যদি এই ভর্মি (কেঁচো)সার আবার মাটির সাথে ব্যবহার করতে পারি তাহলে আশা করি মাটি তার উর্বরতা ফিরে পাবে।
একই গ্রামের কৃষক নুর মোহাম্মদ জানান, এই জৈব সার খুবই ভাল, এই কেঁচো সার এমন একটি সার যেটি মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি করে বহুগুণ। আগে আমাদের মত কৃষকদের বাজার থেকে চড়াদামে সার ক্রয় করতে হতো যার ফলে ফসল উৎপাদনের জন্য অতিরিক্ত খরচ হতো , এখন আবুল বশরের তৈরি সার দিয়ে আমাদের গ্রামের সবাই চাষাবাদ করছি, এতে করে আমাদের নিজের খরচ অনেকটা কমেছে উৎপাদন ও বৃদ্ধি পেয়েছে।
কৃষক আবুল বশর জানিয়েছেন,কেঁচো সার তৈরি করে ২০১৪ সালের অক্টোবর থেকে জানুয়ারির এই পর্যন্ত প্রায় ৪৫ হাজার টাকার কেঁচো সার বিক্রয় করেছেন তিনি। প্রতিবছর তার নিজের চাষের কাজে ব্যবহার করে ৩০ থেকে ৩৫ কেজি বাজারে বিক্রয় করে। বর্তমানে তিনি ৪শতক জমিতে নিজের তৈরি সার দিয়ে শিম,লাউ,বেগুণ,ক্যাপসিকাম,মরিচ,কুমড়া,স্বস্কোস,শসা,ইত্যাদি উৎপাদনে ব্যাপক সফলতা পাচ্ছেন। আবুল বশরের দেখাদেখি এখন রেইছাসহ বান্দরবানের বিভিন্ন এলাকার অনেক কৃষক লাভের মুখ দেখেছেন। কেঁচো সার ব্যবহার করে ফলিয়েছেন বিষমুক্ত সবজি।
আবুল বশর জানান, আমি ২০১৪ সাল থেকে বিভিন্ন সার তৈরি করে নিজের চাষাবাদ পরিচালনা করি। গোবর,তরকারি অবশিষ্ট অংশ,চালের গুড়া,ঘাস,সুটকির গুরু,গরুর রক্ত,মাছ ধোয়া পানি,ব্যবহারিত চাপাতা দিয়েই এই ভর্মি কম্পোস্ট বা কেঁচো সার তৈরি করা হয়। এ সারের উৎপাদন ক্ষমতা বেশি হওয়ার কারনে আমরা বিষমুক্ত বিভিন্ন শাক সবজি উৎপাদন করতে পারছি। গোয়ালিয়া খোলার চাষিদের বেশ কয়েকটি সমবায় সমিতি এখন চাষীদের জৈব সার পদ্ধতিতে চাষ করতে উৎসাহিত করছে। কম খরচে লাভ বেশি হওয়ায় এই পদ্ধতির জনপ্রিয়তা ও বৃদ্ধি পাচ্ছে দিন দিন।
কৃষক আবুল বশর জানান, সরকার কর্তৃক আমাকে সার তৈরির রেজিষ্ট্রশন সুবিধা ও আর্থিক সহযোগিতা প্রদান করলে আমি আমার নিজের তৈরি এই সার জেলার চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সরবরাহ করতে পারবো।
ভর্মি কম্পোস্ট সার তৈরির প্রশিক্ষণ সর্র্ম্পকে জানতে চাইলে সদর উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মো:ওমর ফারুক বলেন, আমরা কেঁচো কম্পোস্ট তৈরি জন্য কৃষকদের প্রশিক্ষণ প্রদান করেছি। গোয়ালিয়া খোলার আবুল বশর সফলতার মুখ দেখছে। তিনি আরো বলেন, আবুল বশরের দেখাদেখি এখন অনেক কৃষক রাসায়নিক সার ত্যাগ করে কেচোঁ সারের দিকে অগ্রসর হচ্ছে।
বান্দরবান কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো:আলতাফ হোসেন বলেন, কেঁচোতে জিবরাইলিক অ্যাসিড নামের এক ধরণের পদার্থ নিঃসরণ করে। গোবর ও পচনশীল উপাদানের সঙ্গে ওই অ্যাসিড মিশে গেলে ইউরিয়া,পটাশসহ বিভিন্ন রাসায়নিক সারের গুণাগুণ এক সঙ্গে পাওয়া যায়। এজন্য এই জৈব সার ব্যবহার করলে আর অন্য কোন সার ব্যবহার করা প্রয়োজন হয় না।
তিনি আরো বলেন,বান্দরবানে অনেক কৃষক এখন রাসায়নিক সার ত্যাগ করে জৈব প্রযুক্তির কেঁচো সার ব্যবহার করা শুরু করেছে। এরই মধ্যে সুয়ালক,গোলিয়াখোলা,ডলুপাড়া ও ক্যামলংয়ের চাষিদের মধ্যে এটি জনপ্রিয় সারে পরিণত হয়েছে।