স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্ব-শরীরে উপস্থিত হয়ে বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র উদ্বোধন করেন। ২০১১ সালের ৫ মার্চ বন্ধ হয়ে যায় দেশের সর্বপ্রথম এ স্যাটেলাইট স্টেশনটি। ফলে এখন মুছে যেতে বসেছে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতার এই স্মৃতিচিহ্ন। তবে স্থানীয়রা বন্ধ এই স্টেশনটিকে মিউজিয়াম করে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি রক্ষার দাবি জানিয়েছেন।
বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন লিমিটেড (বিটিসিএল) সূত্রে জানা যায়, বৈদেশিক টেলিযোগাযোগের জন্য দেশের সর্বপ্রথম স্যাটেলাইট স্টেশন হিসেবে পার্বত্য জেলা রাঙামাটির বেতবুনিয়া এলাকায় ১২৬ একর এলাকা জুড়ে প্রতিষ্ঠিত হয় বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র। ১৯৭০ সালের ৩ জানুয়ারি এটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। স্বাধীনতা পরবর্তী ১৯৭৫ সালের ১৪ জুন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখনকার দেশের একমাত্র এই স্যাটেলাইট স্টেশনটি উদ্বোধন করেন। প্রায় ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত স্যাটেলাইটটির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বিশ্বের সাথে যোগাযোগ শুরু হয় বাংলাদেশের।
বিটিসিএল জানায়, ১৯৯৮ সালে জাপানের একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে স্টেশনটিকে সম্পূর্ণভাবে এনালগ থেকে ডিজিটাল (ইন্টারমিডিয়েট ডাটা রেট-আইডিআর) হিসেবে রূপান্তর করা হয়। হাই পাওয়ার অ্যাম্প্লিফায়ার (এইচপিএ) ত্রুটির কারণে ২০১১ সালের ৫ মার্চ থেকে পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায় স্যাটেলাইট স্টেশনটি। তবে বন্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত সিঙ্গাপুর, আমেরিকা, জাপান (টোকিও), হংকং, সৌদি আরব (রিয়াদ), কাতার (দোহা), বাহরাইন, পাকিস্তান (করাচি), ওমান, কুয়েত, ইউএই (দুবাই), ভারত (বোম্বে) সহ ১২ দেশের ১১৮৪টি সার্কিট ছিল। ২০০৫ সালে ১২৩ জনের অনুমোদিত জনবল ছিল বেতবুনিয়া স্যাটেলাইট স্টেশনে। তবে সময়ের ব্যবধানে এটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অন্যত্র বদলি করা হয়।
সূত্র জানায়, ২০১১ সালে কেন্দ্রটি বন্ধ হওয়ার আগে স্যাটেলাইটের ত্রুটিপূর্ণ এইচপিএর পরিবর্তে সলিড এস্টেট পাওয়ার অ্যাম্প্লিফায়ার (এসএসপিএ) সংগ্রহের টেন্ডার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। তবে পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপনের পর পুরনো স্যাটেলাইটটি কার্যকরে আর কোনো উদ্যোগ নেয়নি বিটিসিএল।
প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা জানান, বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্রের ৫ একর জায়গাতেই বর্তমানে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের গ্রাউন্ড স্টেশন (সজীব ওয়াজেদ জয় ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র) নির্মাণ করা হয়েছে। ২০১৮ সালের ৩১ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এটির উদ্বোধন করেন। এটি ব্যাকআপ গ্রাউন্ড স্টেশন হিসেবে কাজ করছে। এর আগে ওই বছরের ১২ মে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা থেকে সফলভাবে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ মহাকাশে উৎক্ষেপণের মধ্যে দিয়ে বিশ্বের ৫৭তম দেশ হিসেবে বাংলাদেশ স্যাটেলাইট যুগে প্রবেশ করে।
স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের গ্রাউন্ড স্টেশনটি একটি কেপিআই স্থাপনা। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট পাঠানোর আগে বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্রে লোকজন প্রবেশ করতে পারত। কিন্তু গ্রাউন্ড স্টেশন হওয়ার পর এখন লোকজন প্রবেশ করতে পারে না। অথচ পুরনো ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্রের মধ্যে রয়েছে বঙ্গবন্ধুর সেই উদ্বোধনী মঞ্চ। পুরনো কার্যালয়ের অভ্যন্তরে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর নানা স্থিরচিত্র স্মৃতি হয়ে রয়েছে। উপগ্রহের পুরনো যন্ত্রপাতিগুলো পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে আছে। ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্রের পুরনো স্থাপনাগুলোর অবস্থাও জীর্ণশীর্ণ।
নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা এক কর্মকর্তা ক্ষোভের সাথে বলেন, এখানে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিচিহ্ন রয়েছে। অথচ এগুলো সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ নেই। সংরক্ষণ করা হলে স্যাটেলাইট নিয়ে বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগ সম্পর্কে সারাদেশের মানুষ জানত। বিষয়টি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নজরে আনা হলে তিনি অবশ্যই এটি সংরক্ষণের উদ্যোগ নিতেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক বিটিসিএল কর্মকর্তা বলেন,এন্টেনার নিচে একটি লিফট রয়েছে। জাদুঘর বানিয়ে লিফটি ব্যবহার উপযোগী করা হলে মানুষ উপগ্রহ সম্পর্কে সম্যক ধারণা নিতে পারত। তাছাড়া উপগ্রহের জন্য ব্যবহৃত যন্ত্রপাতিগুলো লোকজনকে দেখানো যেত। আগে চুয়েটসহ বিভিন্ন প্রযুক্তি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আসত।
ওই কর্মকর্তা বলেন, পুরনো কেন্দ্রটি ১৯৭৫ সালে নির্মিত হয়েছিল। সেটি ৭৫ সালের প্রযুক্তি। এখন স্যাটেলাইটের আধুনিক প্রযুক্তি চলে এসেছে। তাছাড়া পুরনো স্যাটেলাইট স্টেশনটি অন্য দেশ থেকে স্পেস ভাড়া নিয়ে চালানো হতো। এখন ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট’ উৎক্ষেপনের মাধ্যমে আমাদের নিজস্ব স্যাটেলাইট হয়েছে। তাই পুরনো স্যাটেলাইটটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বিশ্বে এটিই নিয়ম। যে কারণে বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্রকে কার্যকর করার আর সুযোগ নেই বলে জানান তিনি।
স্থানীয় বেতবুনিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান খইচাবাই তালুকদার বলেন, ‘আমরা রাঙামাটি জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে পুরনো বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্রটি জাদুঘর হিসেবে সংরক্ষণের দাবি জানিয়েছিলাম। যতটুকু জানি, এই প্রস্তাবনাটা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়েও পাঠানো হয়েছিল।’ তিনি বলেন, ‘বেতবুনিয়া স্যাটেলাইট স্টেশনটা বঙ্গবন্ধু নিজেই উদ্বোধন করেছিলেন, যে বিষয়টি অনেকেই জানে, অনেকেই জানে না। বিষয়টি প্রজন্মের কাছে জানানোর জন্য আমরা বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্রটিকে জাদুঘর হিসেবে সংরক্ষণের দাবি জানাচ্ছি।’ চেয়ারম্যান খইচাবাই তালুকদার আরো জানান, এখানে বিশাল জায়গা পরিত্যক্ত পড়ে আছে। এসব জায়গা যথাযথ ব্যবহার উপযোগী করতে পারলে সরকার প্রচুর পরিমাণ রাজস্ব আয় করতে পারত বলে মন্তব্য করেন তিনি।
বিটিসিএল রাঙামাটি পার্বত্য জেলার ব্যবস্থাপক (টেলিকম) সত্যজিৎ বড়ুয়া বলেন, ‘বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্রটির কার্যক্রম না থাকলেও এটি কেপিআই (জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা) হিসেবে আছে। এখন বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট হওয়ার পরে এখানে নিরাপত্তার একটি গুরুত্ব রয়েছে। যে কারণে সর্বসাধারণের জন্য এটি উন্মুক্ত থাকছে না।’ বেতবুনিয়া উপকেন্দ্রটি সংরক্ষণ করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে বলে মনে করেন এ কর্মকর্তা। তাছাড়া আগামী বছর বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বার্ষিকীতে বেতবুনিয়াতে একটি কর্মসূচি হওয়ার কথা রয়েছে বলেও জানান তিনি।