পাহাড়ে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে মৌজা বন বা গ্রামীণ সাধারণ বনের (ভিসিএফ) গুরুত্ব অনেক। এসব বন স্থানীয় জনসাধারণের জীবন ও জীবিকার মূল উৎস। খাদ্য, ঘরবাড়ি নির্মাণ ও ওষুধের জন্য পাহাড়ি জনগোষ্ঠী মৌজা বনের ওপর নির্ভরশীল। পাহাড়ি ছড়ায় পানি ধরে রাখতে এ বন ভূমিকা রাখে। স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করে এসব বন সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে। এগুলোকে আইনি স্বীকৃতির আওতায় আনতে হবে। তা হলেই অবশিষ্ট পাহাড়ি বন রক্ষা পাবে। জীববৈচিত্র্য আরও সমৃদ্ধ হবে। পাহাড় ও পাহাড়ের জনগোষ্ঠী তাদের ঐতিহ্য নিয়ে টিকে থাকবে।
‘মৌজা বন বা ভিসিএফ ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণে সংশ্নিষ্টদের করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এসব কথা বলেন।
দৈনিক সমকাল ও জাবারাং কল্যাণ সমিতি বৃহস্পতিবার যৌথভাবে এই বৈঠকের আয়োজন করে। সহযোগিতায় ছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও উন্নয়ন সহযোগী ইউএনডিপি’র যৌথ উদ্যোগের এসআইডি-সিএইচটি প্রজেক্ট।
গোলটেবিলে বক্তারা আরও বলেন, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, জমির দাম বেড়ে যাওয়া, মালিকানাবিরোধ, বিকল্প কর্মসংস্থান না থাকা, আনারস, রাবার, তামাকের মতো ফসলের চাষ বৃদ্ধি, ভূমি অধিগ্রহণ এবং সরকারি নীতি সহায়তার অনুপস্থিতির কারণে ভিসিএফ সংরক্ষণ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে। ছড়াগুলো পানি শূন্য হয়ে পড়ছে। পাহাড়ে ভূমি ধস বাড়ছে। পাহাড় ও পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর টিকে থাকার স্বার্থেই এসব বন রক্ষা করতে হবে। এখানে বাইরে থেকে আনা মডেল চাপিয়ে দেয়া যাবে না।
দৈনিক সমকালের উপসম্পাদক আবু সাঈদ খানের সঞ্চালনায় এ অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন পার্বত্য চট্টগ্রাম ভিসিএফ নেটওয়ার্কের সভাপতি থোয়াইঅং মারমা। স্বাগত বক্তৃতা করেন জাবরাং কল্যাণ সমিতির নির্বাহী পরিচালক মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা।
গোলটেবিল অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব নব বিক্রম কিশোর ত্রিপুরা, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কংজরী চৌধুরী, ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ইন্টিগ্রেটেড মাউন্টেন ডেভেলপমেন্ট-ইসিমড প্রতিনিধি গোলাম রসুল ও ড. ধ্রুপদ চৌধুরী, রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের সদস্য ত্রিদিব কান্তি দাশ, প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক সংস্থাগুলোর আন্তর্জাতিক জোট আইইউসিএনের বাংলাদেশ প্রতিনিধি ইশতিয়াক উদ্দিন আহমেদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশ বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. খালেদ মিসবাহুজ্জামান, পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, এসআইডি-সিএইচটি প্রকল্পের জাতীয় প্রকল্প ব্যবস্থাপক প্রসেনজিৎ চাকমা, বণ্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ অঞ্চল ঢাকার বন সংরক্ষক মো. জাহিদুল কবির এবং পার্বত্য বন ও ভূমি রক্ষা আন্দোলনের জুয়াম লিয়ন আমরলই বম।
আলোচ্য বিষয়ের ওপর আলোকপাত করে আরণ্যকের নির্বাহী পরিচালক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, মানুষ বেড়ে যাওয়ায় পাহাড়ে মৌজা বনের সংখ্যা কমছে। তারপরও ছোট-বড় তিনশতাধিক পাড়া বন টিকে আছে। এগুলো জীববৈচিত্র্যে ভীষণ সমৃদ্ধ।
নিজেদের জরিপের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, এসব বনে এমন অনেক উদ্ভিদ ও প্রাণী টিকে আছে, যা দেশের অন্য স্থানে লুপ্ত হয়েছে বা বিরল হয়ে পড়েছে। এগুলো রক্ষা করতে হলে ভিসিএফগুলোকেও সংরক্ষণ করতে হবে। তবে এর সঙ্গে স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করতে হবে। কারণ তারা জানে কিভাবে এসব বন রক্ষা করতে হয়। সমতলের মডেল তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া যাবে না। বনকে প্রাকৃতিকভাবে বাড়তে দিতে হবে। বনায়নের নামে বাইরের গাছপালা এনে এসব বনে লাগানো যাবে না। স্থানীয় জনগোষ্ঠীর বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। এখানকার গাছপালার ওষুধি গুণাগুণ বিশ্নেষণ করতে হবে। ভিসিএফগুলোকে সংরক্ষণ করতে হলে এদের আয়তন, প্রকৃতি ও জীব বৈচিত্র লিপিবদ্ধ করতে হবে।
ড. খালেদ মিসবাহুজ্জামান বলেন, মৌজা বনগুলো শুধু স্থানীয় বা জাতীয় সম্পদ নয়, এগলোর বৈশ্বিক গুরুত্ব রয়েছে। এসবের কারণে পাহাড়ের ছড়াগুলোতে পানিপ্রবাহ ঠিক থাকে। ওই পানির ওপর আবার পাহাড়ের কৃষিসহ জীবন ও জীবিকা টিকে আছে যুগ যুগ ধরে। জীব বৈচিত্র সমৃদ্ধ এসব বন হতে পারে প্রকৃতি শিক্ষার জীবন্ত গবেষণাগার। তিনি বলেন, মৌজা বন সংরক্ষণে স্থানীয় প্রাণ ও প্রকৃতিকে প্রাধান্য দিতে হবে।
ড. ধ্রুপদ চৌধুরী ভারত ও নেপালে তার কাজের অভিজ্ঞতার আলোকে বলেন, ভিসিএফ সংরক্ষণে লোকায়াত জ্ঞানকে কাজে লাগাতে হবে। প্রথমেই স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মৌলিক চাহিদার ওপর জোর দিতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য দেশের বিদ্যমান বিভিন্ন আইনের মধ্যে বিরোধ রয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, এগুলোর সমন্বয় করতে হবে।
জুয়াম লিয়ন আমলই বম স্থানীয় পরিস্থিতি তুলে ধরে বলেন, বনায়নের নামে বাইরের গাছপালা পাহাড়ে রোপন করলে ভিসিএফ ধ্বংস হয়ে যাবে। বিভিন্ন সংস্থার নামে ভূমি অধিগ্রহণ বন্ধ করার দাবি জানান তিনি।
কংজরী চৌধুরী বলেন, ভিসিএফ কমার সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় বৃক্ষ হারিয়ে যাচ্ছে। কৃত্রিম বনায়নের সময় এ ধরনের গাছ রোপন করতে হবে। কারণ জীব বৈচিত্র রক্ষায় এসব বনে আদি গাছ দরকার।
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান চৌধুরী বন সংরক্ষণে বিদ্যমান আইনের সীমাবদ্ধতা তুলে ধরে তা সংশোধনের ওপর জোর দেন। তিনি বলেন, আইনে বন বিভাগের দায়িত্ব কর্তব্য বলা হয়নি। কৃষি মন্ত্রণালয় নিজে চাষ করে না। তারা তদারকি করে। মাঠে কাজ করে কৃষক। মৎস্য মন্ত্রণালয়ও মাছ চাষ করে না। কিন্তু বন অধিদপ্তর নিজেরা বনায়ন করতে চায়। তাই বাগান হয়, বনায়ন হয় না। বন বিভাগকে তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্ব পালনের পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, বন রক্ষার কাজ স্থানীয় জনগোষ্ঠীর হাতে ছেড়ে দিতে হবে।
ইশতিয়াক উদ্দিন আহমেদ বলেন, মৌজা বন রক্ষা করতে হলে স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে এর মালিকানা দিতে হবে। স্থানীয়দের সমন্বয়ে বন সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে। ভিসিএফ রক্ষায় পৃথক বিধিমালা প্রণয়ন করতে হবে। বনকে অন্য কাজে ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া ঠিক হবে না।
ড. গোলাম রসুল বলেন, মৌজা বন ধ্বংস হলে শুধু পার্বত্য চট্টগ্রাম বা বাংলাদেশের ক্ষতি হবে না-সারা বিশ্বেরই লোকসান হবে। নেপালের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, এ দেশেও এসব বন সংরক্ষণে স্থানীয় অধিবাসীদের সম্পৃক্ত করতে হবে। নিজেদের স্বার্থেই বনজীবী এসব মানুষ ভিসিএফ রক্ষা করবে।
প্রধান অতিথির বক্তৃতায় সচিব নব বিক্রম কিশোর ত্রিপুরা বলেন, ভিসিএফগুলোর আইনি স্বীকৃতি জরুরী। তবে এজন্য তথ্য উপাত্তের প্রয়োজন। তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়নে সব সংস্থার মধ্যে সমন্বয় থাকতে হবে। ভূমি ব্যবস্থাপনা সমস্যার দ্রুত সমাধান করতে হবে। পাহাড়ের জমি অধিগ্রহণ বন্ধ করতে হবে। তিনি স্থানীয় উন্নয়ন সংস্থা ও বেসরকারি সংগঠনগুলোকে প্রয়োজনীয় প্রকল্প নিয়ে সরকারের কাছে উপস্থাপনের পরামর্শ দেন।
প্রসেনজিৎ চাকমা বলেন, বন বিভাগ শুধু অর্থকরী সেগুন, গামার লাগানোতে বেশি উৎসাহী। এ থেকে বন বিভাগকে বেরিয়ে আসতে হবে। তাদের স্থানীয় বনজ বৃক্ষের সম্প্রসারণে কাজ করতে হবে। ত্রিদিব কান্তি দাশ বলেন, ভিসিএফ রক্ষা করতে জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় জনগণকে প্রশিক্ষণ ও সচেতন করে তুলতে হবে।
সমাপনী বক্তৃতায় আবু সাঈদ খান বলেন, ‘সবকিছুর মূলে মানুষ। মানুষের প্রয়োজনে আইন। সবাই উন্নয়ন চায়। কিন্তু তা হতে হবে মানুষের জন্য। মাটি, মানুষ, পাহাড় প্রকৃতিকে রক্ষা করেই সার্বিক উন্নয়ন পরিচালনা করতে হবে।’
এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) শাহজাহান মৃধা, এসআইডি-সিএইচটি প্রকল্পের কর্মকর্তা বিপ্লব চাকমা প্রমুখ।