খাগড়াছড়িতে নির্বিচারে পাহাড়ি বন উজারের হিড়িক

NewsDetails_01

পার্বত্য অঞ্চলে মূলতঃ চার শ্রেণির বন রয়েছে। সংরক্ষিত, রক্ষিত, ব্যক্তিমালিকানাধীন ও অশ্রেণিভুক্ত। এরমধ্যে অধিকাংশ সংরক্ষিত ও অশ্রেণিভুক্ত বন নির্বিচারে উজারের হিড়িক পরেছে। গত চার দশকে বনখেকোদের ভয়াল থাবায় যেভাবে বন উজার হয়েছে, তাতে পাহাড় হারিয়েছে প্রাকৃতিক ভারসাম্য। সেইসাথে হুমকিতে পরেছে জীববৈচিত্র্য। এদিকে বন বিভাগের বিশেষ নজরদারিতেও থামছেনা বন খেকোদের দৌরাত্ম্য,ফলে অরক্ষিত পাহাড়ি বনাঞ্চল।

বন খেকোদের নানা কৌশলে প্রতিনিয়ত বনের এসব গাছ নির্বিচারে কাটা হয়। পাহাড় থেকে পরিবহণ করে সেসব কাঠ যায় ইটভাটা, তামাকচুল্লি ও করাতকলসহ বিভিন্ন জায়গায়।

সাধারণত পার্বত্য চট্টগ্রামে গাছ কাটতে হলে সরকারি ভাবে অনুমোদন নিতে হয়। কিন্তু নজরদারি ও তদারকির অভাবে বিনা অনুমতিতে বন গাছ কেটে নিয়ে যাচ্ছে বনখেকোরা। সম্প্রতি সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ওপর বন বিভাগ বিশেষ নজরদারি বাড়ালেও একেবারেই অরক্ষিত অশ্রেণিভুক্ত বনাঞ্চল। এসব বনাঞ্চল নিয়ে এখনো কোনো জরিপ হয়নি। এসব খাস পাহাড়ে প্রাকৃতিকভাবে যে বনাঞ্চল গড়ে তা অশ্রেণিভুক্ত বনাঞ্চলের আওতাভুক্ত।

অনুসন্ধানে জানা যায়,খাগড়াছড়ি জেলার ৯ উপজেলায় গড়ে উঠেছে অন্তত ৩৬টি ইটের ভাটা। যার একটিরও পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নেই।প্রতি বছর জেলায় অক্টোবর মাসে ইটভাটাগুলোর কাজ শুরু হয় এবং তা চলে মে-জুন পর্যন্ত। বৃষ্টির আগ পর্যন্ত প্রত্যেকটি ইটভাটায় ১২-১৩ রাউন্ড ইট পোড়ানো হয়। প্রত্যেক রাউন্ডে ৭-৮ লাখ ইট পুড়ে। আর প্রত্যেক ইটভাটায় বছরে গড়ে এক কোটি ইট উৎপাদন হয়। খাগড়াছড়ির সব ভাটায় বছরে প্রায় ৩৬ কোটি ইট তৈরি হয়, যার বাজার মূল্য প্রায় ২৫২ থেকে ৩২৪ কোটি টাকা (প্রতি হাজার গড়ে ৭-৯ হাজার টাকা দরে)।

সূত্র মতে,প্রতি রাউন্ড ইট পোড়াতে প্রায় ৮-৯ হাজার মণ জ্বালানি কাঠ লাগে এবং এক মৌসুমে একটি ইটভাটায় গড়ে কাঠ পুড়ে প্রায় এক লাখ মণ। সেই হিসেবে ৩৬ ইটভাটায় বছরে কমপক্ষে ৩৬ লাখ মণ কাঠ পুড়ছে।

এছাড়া জেলার আনাচে-কানাচে গড়ে উঠেছে প্রায় দুই শতাধিক করাতকল। যার অর্ধেকেরই বন বিভাগ ও পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নেই। এসব অবৈধ করাত কলের মালিকানায় রয়েছে স্থানীয় রাজনৈতিক ও আঞ্চলিক দলের প্রভাবশালী নেতাদের নাম।

বন ও পরিবেশ আইন অনুযায়ী, সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ১০ কিলোমিটারের মধ্যে করাতকল স্থাপনের কোনো নিয়ম না থাকলেও এসবের তোয়াক্কা করেন না বনখেকোরা। সংরক্ষিত বনাঞ্চল ঘিরেই অবৈধভাবে করাতকল স্থাপন করে দিনে-রাতে কাটা হচ্ছে সংরক্ষিত বনের কাঠ।

করাতকল মিস্ত্রিদের সাথে কথা বলে জানা যায়, প্রতিটি করাতকলে দৈনিক অন্তত ১০০ থেকে ১৫০ ঘনফুট পর্যন্ত কাঠ চিরানো হয়। সেই হিসেবে খাগড়াছড়ি জেলার করাতকলগুলোতে প্রাত্যহিক গড়ে অন্তত সাড়ে ২২ হাজার ঘনফুট কাঠ চেরা হয়। বছর শেষে যার পরিমাণ ৮০ লাখ ঘনফুট ছাড়িয়ে যায়। এছাড়া খাগড়াছড়িতে প্রতিবছর ছয় শতাধিক হেক্টর কৃষি জমিতে তামাক চাষ করা হয়। এসব তামাক পাতা পোড়াতে প্রয়োজন হয় প্রায় ৪ লক্ষ মণ কাঠের। আর এই চাহিদা পূরণের জন্য পাহাড়ের বড় ছোট গাছ কেটে প্রতিটি তামাক চুল্লির দুয়ারে পৌছে দেয়া হচ্ছে। বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা উপেক্ষা করে এসব বন থেকে নির্বিচারে গাছ কেটে নিচ্ছে বনখেকোরা।

NewsDetails_03

এছাড়াও অপরিকল্পিত অবকাঠামো নির্মাণের কারণে বনের পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। বন ধ্বংসের কারণে হারিয়ে যাচ্ছে শত প্রজাতির বৃক্ষ, লতা-গুল্ম। বিচরণ ক্ষেত্র কমে যাওয়ায় বনের ওপর নির্ভরশীল বণ্যপ্রাণী বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। প্রাকৃতিক বন বিপন্ন হওয়ায় বিপন্ন হয়ে উঠছে বনের ওপর নির্ভরশীল মানুষরা। বন ধ্বংস হওয়ায় পানি উৎস কমেছে প্রায় ৬১ শতাংশ। শুষ্ক মৌসুমে ঝিরি ঝরনায় পানি উৎস কমে আসে।

সম্প্রতি খাগড়াছড়ি-দীঘিনালা সড়কের ৮ মাইল এলাকায় যেতে যেতে চোখে পড়ে বনের গাছ পরিবহণ করতে প্রস্তুত করছে তিন শ্রমিক। এসময় গাছের কাজে নিয়জিত শ্রমিকদের কাছে জানতে চাইলে নাম না প্রকাশ করার শর্তে জানান, ‘গাছগুলো মাঝি পাহাড়ের আরেক মালিক থেকে ক্রয় করেছে। এগুলো স্থানীয় ফোরস্টার ব্রিকসে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।

জানা যায়, বছরে ৫মাস দৈনিক ৪শ’-৬শ’ টাকা মজুরির ভিত্তিতে শ্রমিকদের যুক্ত করা হয় এসব কাজে। তারা পাহাড় থেকে গাছ কর্তন ও পরিবহন করে নিয়ে যায় ইটভাটা, করাতকল ও তামাকচুল্লিতে।
গাছ কাটা শ্রমিক হাবিবুল্লাহ, মিজান ও সোলেমান জানান, ‘চাপালিশ, চম্পাফুল,সুরুজ,জাম,রাবার ও গামারিসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ কাটা হয়। এসব গাছ ইটভাটা ও তামাকচুল্লিসহ বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা হয়। সাইজের গাছগুলো যায় করাতকলে। বছরে অন্তত ৫ মাস এভাবেই কাজ চলে।’

ইটভাটায় গাছ সরবরাহকারী মাঝি ‘মো. রুবেল মিয়া জানান, স্থানীয়দের কাছ থেকে পাহাড়ের গাছ কিনে নেই। তারপর সেসব গাছ শ্রমিক দিয়ে কেটে পরিবহন করে ইটভাটায় বিক্রি করি৷ পেটের দায়ে এ ব্যবসা করি৷ আমার মতো এমন শতশত ব্যবসায়ী আছে।’

খাগড়াছড়িতে বন উজার বন্ধে প্রচলিত আইনের কঠোর প্রয়োগ চান স্থানীয়রা।

স্থানীয় সাবেক ইউপি সদস্য গনেশ ত্রিপুরা বলেন, ‘আগে পাহাড়ি ঝিরি ও ঝর্ণায় পানি থাকতো। কিন্তু গত চার দশকে যেভাবে বন উজার হয়েছে, তাতে ঝিরি ও ঝর্ণাগুলোতে পানি শুকিয়ে গেছে। এতেকরে আমাদের জীবন যাত্রা অনেক দুর্বিষহ। বন উজার বন্ধে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে প্রচলিত আইনের কঠোর প্রয়োগ করার অনুরোধ করছি।’

খাগড়াছড়ির বন্যপ্রাণী বিষয়ক আলোকচিত্রী সবুজ চাকমা বলেন, ‘পাহাড়ে যেভাবে নির্বিচারে বন উজার হচ্ছে। তাতেকরে বিভিন্ন প্রজাতির পশুপাখি আজ বিপন্ন। একসময় অনন্ত ৩৭৫ প্রজাতির পাখি দেখা গেলেও আজ তা হারিয়ে গেছে। বন মাটি নির্মল রাখে, পানির উৎস সতেজ রাখে এবং মাটির ক্ষয় রোধ করে।’

খাগড়াছড়ি পরিবেশ সুরক্ষা আন্দোলনের সভাপতি প্রদীপ চৌধুরী জানান,’অনুমতি ছাড়া অশ্রেণিভুক্ত বনের গাছ কাটার কোনো নিয়ম নেই। কিন্তু খাগড়াছড়িতে নির্বিচারে বন কর্তন হচ্ছে ও কোনো বাধা ছাড়া বন উজাড় হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে একসময় সবুজ পাহাড় বলতে আর কিছু থাকবে না।’

খাগড়াছড়ির বিভাগীয় বন কর্মকর্তা হুমায়ন কবির জানান,’বিনা অনুমতিতে বন থেকে গাছ কর্তনের সুযোগ নেই। অবৈধভাবে কেউ বনজ দ্রব্য পরিবহণ করলে তার বিরুদ্ধে বন বিভাগ ব্যবস্থা নিবে। ইটভাটা ও তামাক চুল্লিতে বনের কাঠ পোড়ানো সর্ম্পূণ নিষেধ। কেউ যদি বনের কাঠ ব্যবহার করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য মাঠ পর্যায়ে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।’

আরও পড়ুন