ঝুঁকিতে বান্দরবানের প্রাকৃতিক পরিবেশ

NewsDetails_01

বান্দরবানের পরিবেশের কোনো অংশই আজ দূষণমুক্ত নয়। প্রতিনিয়ত প্রাকৃতিক পরিবেশের দূষণ ঘটছে ব্যাপক হারে। দিন দিন বদলে যাচ্ছে জলবায়ু পরিস্থিতি। দূষণের ঝুঁকিতে পড়ে মানুষসহ সকল উদ্ভিদ ও প্রাণীর জীবন ধারণে বিঘ্ন
ঘটেছে, ফলে স্থানীয়দের মধ্যে বাড়ছে উৎকন্ঠা।
পরিবেশের মাটি, পানি ও বায়ু, মাটির ওপরের পানি এমনকি ভূগর্ভস্থ পানি কোনো কিছুই নিরাপদে নেই। জেলা জুঁড়ে অবাধে পাহাড় কাটা, বৃক্ষ নিধন, পাহাড় খুঁড়ে পাথর উত্তোলন, জমিতে মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহার, তামাক চাষ, পাহাড়ের ভিতর ইটভাটা ও করাত কল স্থাপন করা হচ্ছে। যা আবহাওয়ার বিরূপ আচরণ ও জলবায়ু পরিবর্তনে মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পরিবেশের ভারসাম্য, দেখা দিচ্ছে মানুষের শরীরে নানা রোগ ব্যাধি।
পরিবেশবাদীদের মতে, এ অবস্থার পরিবর্তন করা না গেলে; পরিবেশ ও জলবাযু পরিস্থিতি আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য হয়ে উঠবে চরম হুমকিস্বরূপ। সামগ্রিকভাবে পরিবেশ দূষণের মাত্রা ভয়াবহ আকার ধারণ করলেও জন সচেতনতা বাড়াতে প্রশাসনের নেই তেমন কোন কার্যকরী উদ্যোগ।
স্থানীয় বাসিন্দা ও পরিবেশবাদীদের অভিযোগ, প্রভাবশালীরা বিভিন্ন কৌশলে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের জমি দিন দিন গ্রাস করার কারনে সবুজ বেষ্টিত বন ধীরে ধীরে সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। বন বিভাগ ভূমি ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী করে প্রভাবশালীদের হাত থেকে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের জমি রক্ষা করতে না পারলে আগামী কয়েক দশকের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম মাতামুহুরী ও বমু রিজার্ভসহ জীববৈচিত্র্য হারিয়ে যাবে। শুধু তাই নয়, ব্যক্তি মালিকানাধীন বনভূমিগুলোর ওপরও সৃজিত গাছ কেটে ন্যাড়া করে ব্যাপক হারে ঘরবাড়ি নির্মাণ করা হচ্ছে। এতেও উজাড় হচ্ছে হচ্ছে গাছপালা তথা বনভূমি।
অপরদিকে, নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে জেলার ৭টি উপজেলায় বনের ভেতর বৈধ ও অবৈধভাবে একের পর এক করাতকল গড়ে উঠছে। করাতকলগুলোতে হাজার হাজার গাছ চেরাই করার ফলে উজাড় হচ্ছে বন। এদিকে পাহাড় খুঁড়ে অবাধে পাথর উত্তোলন করার ফলে পাহাড়ের ওপর সৃজিত গাছ ধবংস হওয়ার ফলে হারিয়ে যাচ্ছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও জীববৈচিত্র্য, ধ্বংস হচ্ছে প্রাকৃতিক পরিবেশ।
আরো জানা গেছে,পাহাড় কাটার বিরুপ প্রতিক্রিয়ায় ২০০৯ সালে লামার আজিজনগর ও গজালিয়ায় পাহাড় ধসে এক পরিবারের ৬জনসহ ১১ জন, ১৯৯৬ সালে পৌর এলাকায় একই পরিবারের ৭জন, ২০১২ সালের ২৭ জুন রাতে ফাইতংয়ে ২৫ জন, রুপসীপাড়ায় ২জন ও সদর ইউনিয়নে ২ জন, ২০১৫ সালের ৩০ জুলাই লামা সদর ইউনিয়নে ৬জন এবং চলতি বছরের ৩ জুলাই সরই ইউনিয়নের কালাইয়া পাড়া ৩জন মারা যান। বিগত বছরগুলোতে নাইক্ষ্যংছড়ি,বান্দরবান সদর উপজেলাসহ জেলার বিভিন্ন স্থানে পাহাড় ধসে মারা গেছে আরও প্রায় অর্ধ শতাধিক মানুষ।
এছাড়া বৈধ ও অবৈধ ইটভাটায় টনের পর টন গাছ জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করায় পরিবেশে কার্বনের পরিমাণ যেমন বাড়ছে, তেমনিভাবে কমছে গাছের সংখ্যা। শ্রমিকদের তথ্য মতে, একটি ভাটায় দৈনিক গড়ে ৩০০ মণের উপর কাঠের প্রয়োজন হয়, সে হিসাবে এতে ধ্বংস হচ্ছে ভাটার আশপাশের বনাঞ্চল। আবার ইটভাটার ধুলো আর ধোঁয়ায় এলাকার ফসলী জমি, ফলজ বনজ গাছে দেখা দিয়েছে বিরূপ প্রতিক্রিয়া।
স্থানীয় কৃষক নুর জামাল ও মো. ইব্রাহীমসহ আরো অনেকে বলেন, ইটভাটার কালো ধোঁয়া আর বিষাক্ত গ্যাসে প্রথমে ধান ও সবজি গাছ ঝলসে যায়। এরপর আস্তে আস্তে ধান ও ফসলে পচন ধরার পাশাপাশি গাছ শুকিয়ে মরে যায়। শুধু ধান ও সবজিই নয়, আম, কাঁঠাল, কলা, লিচু, আনারস, জাম, জলপাইসহ অন্যান্য ফলসহ গাছ ঝলসে একই ক্ষতি হয়ে থাকে।
ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন(নিয়ন্ত্রণ) আইন- ২০১৩ এ লাইসেন্স ছাড়া ইটভাটা পরিচালনা করলে এক বছরের দন্ড এবং ৫০ হাজার টাকা জরিমানা, আবাসিক-সংরক্ষিত-বাণিজ্যিক-বনভূমি-জলাভূমিসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা এলাকায় ইটভাটা স্থাপন করলে এক বছর দন্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়। জ্বালানি হিসেবে কাঠের ব্যবহারে তিন বছরের কারাদন্ড এবং তিন লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হওয়ার বিধান রাখা হয়। কিন্তু ক্ষোধ বনের ভেতরে গড়ে উঠছে একের পর এক ইটের ভাটা। ইট ভাটার কারনে ফসলহানি, ফল ও সবজি পচে যাওয়া, কুঁকড়ানোসহ নানা সমস্যা দেখা দিচ্ছে। মানুষের মাঝে ছড়িয়ে পড়ছে নানা রোগ ব্যাধি।
লামা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক চিকিৎসক শফিউর রহমান মজুমদার জানান, নানা কারণে পানি দূষিত হতে পারে। দূষিত পানির কারণে কেমিক্যাল পয়জনিং হয়ে মানুষ মারাও যেতে পারে। এ ছাড়া গর্ভবতী মায়েরা নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। অনেক সময়ে গর্ভেই সন্তান নষ্ট হচ্ছে। অটিস্টিক শিশু ভূমিষ্ঠের পিছনেও দায়ী দূষিত পানি। এছাড়া পানি দূষিত হলে নদী খাল বিল ও পুকুরের মাছ মরে যাওয়াসহ প্রজননেও বিঘ্ন ঘটতে পারে।
আগ্রাসি নদী দখল আর দূষণে নদীতে মাছ নেই বললেই চলে, নদী রূপ নিচ্ছে মরা খালে। দখল ও দূষণে হারিয়ে যেতে বসেছে জেলার সাঙ্গু, বাঁকখালী, মাতামুহুরী নদীসহ অসংখ্য খাল ও ঝিরি। দখলবাজদের দৌরাত্বে অস্তিত্ব হারাচ্ছে এসব নদী, খাল ও ঝিরির অংশ। নদী এলাকায় পাহাড় কর্তনের কারণে মাটি ক্ষয় হয়ে ভরাট হচ্ছে নদী, সেই সাথে বিষাক্ত বর্জ্যে নদীর পানি দূষিত হচ্ছে। ফলে নদী, খাল ও ঝিরির মাছসহ নানা জলজ প্রাণী হারিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া তামাক চাষে মাত্রারিক্ত কীটনাশক ব্যবহারসহ বাসা বাড়ির মলমূত্র, গৃহস্থালী, হাটবাজারের বর্জ্যও মিশছে নদী, খাল ও ঝিরির পানিতে। ফলে নদীর পানি দূষিত হচ্ছে ভয়াবহ হারে। যানবাহন থেকে নির্গত ধোঁয়া ও রাসায়নিক মিশ্রিত শিল্প বর্জ্য, ময়লা-আবর্জনা, পলিথিন, প্লাাস্টিক ইত্যাদি পরিবেশের উপাদানকে দূষিত করছে।
অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে পয়ঃ নিষ্কাশন ও বর্জ্য অনেক বেড়ে গেছে, এর ফলে পানি দূষিত হওয়ায় পানিতে মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণীও বাঁচতে পারে না। বর্তমানেও জেলার বিভিন্ন স্থানে পরিবেশ বিধ্বংসী কর্মকান্ড অব্যাহত রয়েছে। পরিবেশ রক্ষায় প্রশাসনকে আরও কঠোর হওয়ার আহবান জানান ভুক্তোভোগীরা।
এই ব্যাপারে বান্দরবানের জেলা প্রশাসক মো. আসলাম হোসেন পাহাড়বার্তাকে বলেন, বান্দরবানের পরিবেশ রক্ষায় গুরুত্বসহকারে জেলা প্রশাসন কাজ করছে। জেলার কোথাও পরিবেশের ক্ষতি হয়, এমন কর্মকান্ড যেন কেউ ঘটাতে না পারে; সে বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেয়া আছে।

আরও পড়ুন