দুনিয়া জুড়েই চলছে অস্থিরতা আর ক্ষমতার লড়াই। কভিড-১৯ সংকটকালীন সময়ে মানুষের মধ্যে যে সারল্য আর উদারনৈতিক ভাবাপন্ন মানসিকতা তৈরি হয়েছে সেটি কেটে গেছে কভিডের সংকট কাটার পরপরই। মানুষ মূলত এমনই। তারা প্রয়োজনে, তাগিদে অনেক কথাই বলেন ভাবেন, কিন্তু আর প্রয়োজন শেষে সে সব কথা ভুলে যান, মত-পথ পাল্টান মুহুর্তেই। এটি আমাদের জাতীয় চরিত্র হয়ে ঠেকেছে। কভিডের সংকটের সময় মানুষের মধ্যে আমরা এক ধরণের সারল্য দেখেছি। মানুষ ভাবতে শুরু করেছেন বলেছেন জীবনের মূল্য খুবই কম এবং ঠুনকো। যখন তাদের বিপুল অর্থ ভৈভব থাকার বেঁচে থাকার নিদারুণ সংশয় তখন তারা সারল্য হয়েছে মানে সারল্যের ভাব ধরেছেন। কিন্তু যখন সব কিছু স্বাভাবিক হলো তারা আবার ফের পুরনো চেহারায় ফিরেছেন, পুরনো রূপ নিয়েছেন। পুঁজির পেছনে অর্থের পেছনে আকাক্সক্ষা পূরণে দৌঁড়ঝাপ শুরু করেছেন। মূলত মানুষ হিসেবে আমরা এমনই; বহুচরিত্র, লোকরঞ্জনবাদের দিকে বরাবরের আমাদের এগিয়ে চলার নিদারুণ প্রচেষ্টা বরাবরের মতোই।
বিশ্ব জুড়ে আরেক কৃত্রিম সংকটের মুখোমুখি করেছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট সংকট। যে সংকটের সমাধান আজও হয়নি। কেউই কাউকে ছাড় দেয়নি, দিচ্ছে না। এই সংকটের সুরাহা কি আদৌ হবে ক্ষমতার লড়াইয়ে? এই সংকটের মধ্যে আবারও পুরনো আরেক সংকট মাথা তুলেছে; সেটি ফিলিস্তিন আর ইসরায়েল সংকট। দশকের পর দশক ধরে চলছে এই সংকট, যুদ্ধ। ক্ষমতা আর স্বার্থের দ্বন্দ্বে বিশ্ব মোড়লেরা সবখানেই পক্ষপাতিত্ব করেন, এখানেও তাই করছেন। নীতি নৈতিকতার প্রশ্ন স্বার্থের কাছে কিছুই না। কেবল নিজেদের স্বার্থেই নীতি কথা শোনান। সব মিলিয়ে বিশ্ব জুড়ে এই অস্থিরতার পেছনে জড়িত কেবল স্বার্থ আর কর্তৃত্বাবাদের লড়াই।
কভিড পরবর্তীতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফসল হিসেবে বিশ্বজুড়ে যে বৈশ্বিক মন্দার সৃষ্টি হয়েছে সেটির প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশেও। দেশের অর্থনীতি, নিত্যপণ্যের বাজার, ডলার সংকট, ব্যাংকিং খাতসহ সব ক’টি সেক্টরেই চলছে অস্থিরতা, মন্দাভাব। মানুষের জীবনে নাভিশ্বাস উঠেছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের যে দাম বাড়ছে সেটি আর কমছেই না। কমলেই যে পণ্যে ২০ টাকা বাড়ে কমে ৫ টাকা! এভাবেই চলছে বাড়া কমার খেলা। মূলত এভাবেই বাড়া-কমার রাজনীতি করা হচ্ছে মানুষের সঙ্গে। কর্তৃপক্ষ দায়সারা মন্তব্য আর নামকাওয়াস্তের বাজার নিয়ন্ত্রণের গল্প মানুষের সঙ্গে রীতিমতো তামাশার শামিল।
বাংলাদেশের গরিব মানুষের; বিশেষত আমাদের মতো মানুষের আমিষের অভাব পূরণ করতো ডিম আর ‘গরিবের মাছ’ হিসেবে খ্যাত পাঙাশ। এখন ডিম আর পাঙাশের দামও গরিবের নিয়ন্ত্রণে নেই, গরিব কিনতে পারেন না। কিছু মানুষের উদাহরণ দিয়ে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার সুযোগ খুঁজি লাভ নেই। এত এত উৎপাদনের গল্পের মাঝে ভারত থেকে ডিম আমদানি করে বাজার নিয়ন্ত্রণের যে উদ্যোগের কথা সরকার বলেছে সেই উদ্যোগও মুখেই আটকে আছে। সরকারেরর ঘোষণার দেড় মাসেও দেশে একটি ডিম আমদানি করা যায়নি। ডিমের কথা না হয় বাদ-ই দিলাম; মানুষ না হয় ডিম খাওয়া ছেড়েই দিলেন বা দেবেন কিন্তু আলু? আলু বাংলাদেশের মানুষের একটি অতি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে পরিণত হয়েছে। আলু খান না এদেশে এমন মানুষ খুবই কম আছেন। মাছ মাংসে আলু, শাক-সবজিতে আলুর ব্যবহার থেকে শুরু বাজারের পটেটো চিপস-সব খানেই আলু আর আলু। মানুষের এই আলু এখন গরিবের কাছ থেকে হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। ১৫-২০ টাকা কেজির আলুর দাম এখন থেকেছে ৬০-৭০ টাকায়! গরিব মানুষ খাবে কী? ডিম তো গেছে; এবার কি আলুও গেলো?
পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদন সূত্রে জানতে পারলাম, সরকারের দেয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশে আলুর উৎপাদন হয় চাহিদার চেয়ে বেশি। উদ্বৃত্ত উৎপাদনের সুবিধা নিতে কৃষিপণ্যটির রপ্তানি বাড়াতে এখন পর্যন্ত নানা উদ্যোগও নিয়েছিল কৃষি মন্ত্রণালয়। এ নিয়ে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে আলোচনাও করেছে। কিন্তু এখন দেশের বাজারে পণ্যটির সরবারহ চাহিদার চেয়ে কমে যাওয়ায় অস্থিতিশীলতার মধ্যে আলুর বাজারদর। এরই মধ্যে বাজার স্থিতিশীল রাখতে আলু আমদানির সিদ্ধান্ত নিচ্ছে বাণিজ্য মন্ত্রনালয়। চাহিদার চেয়ে যদি বেশি উৎপাদন হয়ে থাকে সেক্ষেত্রে আমদানি করতে হবে কেন? আর যদি আলু ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে আলুর বাজারদর বৃদ্ধি করে থাকে তাহলে সরকার কেন আলুর দাম নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না, সিন্ডিকেট ভাঙতে পারছে না। সরকার কি আলু সিন্ডিকেটের চেয়েও দুর্বল নাকি সরকারের ভেতরেই সিন্ডিকেট ওয়ালাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়া হচ্ছে? বাংলাদেশের মানুষ এখন বেশিরভাগ দুইবেলা ভাত খান। এখন এই দুই বেলাও সুষম খাদ্য খেতে পারছেন না। মানুষের আয় রোজগার না বাড়লেও নিত্য পণ্যসহ অন্যান্য জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে কয়েকগুন। মানুষের এখন সংসার চালাতে বড়ই কষ্ট। এর মধ্যে সরকারি মন্ত্রী কর্মকর্তাদের বাহাস আর ডলারের হিসাবে নিত্য পণ্যের দামের তুলনা যেন গরিবের দুঃখের মাঝে ‘আগুনে ঘি ঢালার’ মতো অবস্থা।
এদিকে, গত রোববার সরকারের পদত্যাগ, খালেদা জিয়ার মুক্তি এবং তত্ত্বাবধায় সরকারের অধীনে নির্বাচনের এক দফা দাবিতে হরতাল অবরোধ পালন করেছে বিএনপি-জামায়াত জোট। মঙ্গলবার থেকে আগামী বৃহস্পতিবার তিন দিনের ৭২ ঘন্টার টানা অবরোধের ডাক দিয়েছে বিএনপি-জামায়াত। অন্যদিকে, আওয়ামী লীগও হরতাল-অবরোধে ‘নাশকতা ঠেকাতে’ মাঠে তৎপর ভূমিকা রাখছে। আবারও দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা যে শুরু হয়েছে সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না। আর এই অস্থিরতা কেবল দুই দলের ক্ষমতা আর শাসনের জন্য লড়াই। কিন্তু এই দুই দলের মধ্যে বিএনপি নেতারা বলছেন, ‘তারা হরতাল অবরোধ ডেকেছেন জনগণ সেটি পালন করবে।’ আবার আওয়ামী লীগ নেতারাও একই ভাবে বলছেন, ‘বিএনপি-জামায়াতের নৈরাজ্য জনগণ ঠেকিয়ে দেবেন।’ দুই রাজনৈতিক দলই দৃশ্যত একই ভাবে কথা বলছেন আর জনগণের ওপর দায় চাপাচ্ছেন, তাদের নিয়ে খেলছেন! কিন্তু জনগণের কি হরতাল-অবরোধ পালন কিংবা ‘নৈরাজ্য’ ঠেকাতে ঠেকা লাগছে? বাংলাদেশের বেশির ভাগ সাধারণ মানুষ এখন চুপচাপ আছেন; তাদের দিন যাচ্ছে অর্থাভাবে আর কষ্টে। কিন্তু মুখ ফুটে কথা বলছেন না বেশির ভাগ মানুষ। মানুষের মধ্যে এক ধরণের উদ্বেগ যারা আছে তারা এমন নতুন কেউ ক্ষমতায় এলে আবার কেমন হবে? পরিস্থিতি উন্নতি হবে নাকি আরও অবনতি হবে এসব নিয়ে তাদের ভাবনা আছে। দিন শেষে মানুষ ভালো থাকতে চান, সহনীয় বাজার ব্যবস্থা চান। নিরাপদ জীবন চান। বেশি কিছু চান না।
দুই দলই বর্তমানে ক্ষমতার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেছে। আওয়ামী লীগ তাদের প্রায় ১৫ বছরের টানা শাসন পুনরায় নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। অন্যদিকে ক্ষমতার বাহিরে থাকা বিএনপি হারানো গদি দখলের চেষ্টা। দুই দলেরই মধ্যকার এই রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে ৬০ টাকার মধ্যে কোনো সবজি পাওয়া যাচ্ছে না বাজারে! আলুর দাম ছুঁয়েছে ৫০ থেকে ৭০ টাকায়। আর পেঁয়াজ ঝাঁজ উঠেছে ১২০-১৩০-এ। মানুষ জন্য এখন কেউই কথা বলছেন না। রাজনৈতিক দলগুলো পড়ে আছে ক্ষমতার আকাক্সক্ষায়। সেখানে সাধারণ মানুষের কোন ঠেকা পড়েছে তাদের জন্য ঝাপাইতে। সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে বাজারদর, দুই বেলা মাছ মাংসে খেয়ে বেঁচে থাকা। আপনাদের ক্ষমতার লড়াইয়ে কেন তাদের পিষ্ট করছেন?
প্রান্ত রনি
লেখক: সাংবাদিক