শিশুর ভবিষ্যতের জন্য আমরা কী বিনিয়োগ করছি ?

NewsDetails_01

ইংরেজি সনের অক্টোবর মাসের প্রথম সোমবার পালিত হয়ে থাকে বিশ্ব শিশু দিবস। এবছর ২ অক্টোবর সোমবার; বিশ্ব শিশু দিবস পালন করা হয়েছে। সারা বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রতি বছরই অক্টোবরের প্রথম সোমবার বাংলাদেশে ‘বিশ্ব শিশু দিবস’ পালন করা হয়ে থাকে। এবারও দিবসটি পালন উপলক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচি-অনুষ্ঠানমালা ঘোষণা করেছে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়। ২ থেকে ৮ অক্টোবর পর্যন্ত সপ্তাহব্যাপী পালিত হবে শিশু অধিকার সপ্তাহও। এবছর দিবসটি প্রতিপাদ্য বিষয় করা হয়েছে- ‘শিশুর জন্য বিনিয়োগ করি, ভবিষ্যতের বিশ্ব গড়ি’। প্রতিপাদ্য বিষয়ের সূত্র ধরেই প্রশ্ন রাখতে চাই শিশুর জন্য আমরা কেমন বিনিয়োগ করছি, কেমন ভবিষ্যৎ চাই?

একটা গল্প দিয়েই শুরু করতে চাই। বেশি দিন হয়নি, এ বছরই একদিন বড় ভাইয়ের সঙ্গে বেড়াতে বের হয়েছিলাম। আলাপ প্রসঙ্গে তিনি বললেন আমার মাঝে মাঝে মন চায় সব কিছু ছেড়ে সেই ছেলে-বেলায় ফিরে যাই। যখন আমাদের সব কিছু নিয়ে এত বেশি ভাবতে হতো না, কোনো চিন্তা করতে হতো না। কে কেমন, কোন ধর্মাবলম্বী, জাতিগোষ্ঠীর মানুষ এসব নিয়ে কোনো ভাবনা ছিল। তখন শুধু ভাবনা ছিল বন্ধু-বান্ধবীরা সবাই মিলে সকালে স্কুলে যাব, পড়ব। সকালে স্কুলের বাসের জন্য অপেক্ষা আর বিকালে এক সঙ্গে সেই বাসে করে বাড়ি ফেরা। তিনি মূলত দেড়-দুই দশক আগের শহুরে জীবনের শিশুদের ছেলেবেলার নিত্য দিনের কথাই বলত চেয়েছেন।

আমাদের ছেলেবেলা কিংবা শিশুকাল সবারই কেটেছে। হয়তো কারও ধনাঢ্য পরিবারে, কারও নি¤œবিত্ত কিংবা মধ্যবিত্ত পরিবারে। কেউ বেড়ে উঠেছেন গ্রামে কেউবা শহরে। আমার ছেলেবেলার কথা যদি বলি, তাহলে বলতেই হয় সেই দিনের মতো আর কোনো দিনই আমরা ফিরে পাব না, আমাদের ফেলে আসা সেইসব দিন আর কখনোই ফিরে আসবেনা। আমাদের শৈশব কেটেছে খেলাধূলায়, গল্প আড্ডায়। ঘুঁড়ি উঁড়িয়েছি, পানিতে সাঁতার কেটেছি। বিকালে বন্ধুরা মিলে বিভিন্ন খেলাধূলায় ব্যস্ত সময় পার করেছি। যদিও এখনকার সময়ের মতো মোবাইল, ইন্টারনেটের সুব্যবস্থা ছিল না। সপ্তাহের দুদিন নিয়ম করে বাংলা সিনেমার ছায়াছবি দেখতাম। শুক্রবারের ‘আলিফ-লায়লা’ ছিল যেন পুরো সপ্তাহের অপেক্ষা।

এখনকার সময় সহজ হয়েছে। সব বেশি কঠিন থেকে সহজলভ্য হয়েছে। হাতের মুঠোয় মোবাইল ফোন-ইন্টারনেট। শিশুরাও নিয়মিত ইউবটিউব দেখছেন। ইন্টারনেটে বিভিন্ন বিষয় দেখছেন। একেবারে বলতে মোবাইল ফোন যেন তাদের নিত্য সঙ্গি-বন্ধুত্বের অভাব পূরণ করছে। এইভাবেই তাদের আমরাই তৈরি করছি, বেড়ে উঠাচ্ছি বড় করছি। এখনকার সময়ে শহুরা শিশুরা পুরোটা সময়ই যেন ঘরবন্দি। একই প্রভাব পড়েছে এখন গ্রামেও। এই ইন্টারনেট, মোবাইলের প্রভাব পড়েছে শিশুর বেড়ে ওঠায়। শিশুরা এখন খেলাধূলার চেয়েও মোবাইল ফোন-ইন্টারনেটের দিকে বেশি ঝুঁকে পড়ছে। আমরাও সেই সুযোগ করে দিচ্ছি। ৪-৫ বছর থেকেই শিশুকে ব্যস্ত রাখতে, ব্যস্ত রেখে ঘরের-নিজের কাজ সামলাতে মোবাইল ফোন তুলে দিচ্ছি। ঠিক আমরা এমনই বিনিয়োগ করে যাচ্ছি। তাহলে ভাবুন এই বিনিয়োগের ফলে আমরা কেমন ভবিষ্যৎ প্রত্যাশা করছি। কথায় প্রচলিত আছে ‘যেমন কর্ম, তেমনই ফল’। আমরা তো শিশুদের হাতে মোবাইল ইন্টারনেট তুলে দিয়েছি তাহলে ফল হিসেবে আমরা কি এই শিশুদের বিজ্ঞানী, গবেষক হিসেবে পাব?

আগেকার সময়ে ছেলে শিশু-কন্যা শিশুদের ছেলে বেলায় নাচ-গান শেখাতে হতো। কেউ কেউ আঁকাআঁকি শিখতে। অনেকে এখনও শেখেন। গ্রামেও ছিল এমন চিত্র। এখনও প্রচলন আছে। তবে এখনকার সময় আগের থেবে অনেক কমেছে। বেশির ভাগ অভিভাবকই মনে করেন তাঁর সন্তানকে যেহেতু নৃত্যশিল্পী, চিত্রশিল্পী, গায়ক-গায়িকা ইত্যাদি বানাবেন না; সেক্ষেত্রে এসব শিখিয়ে লাভ কী। তাই বেশির ভাগ অভিভাবকই শিশু সন্তানকে অ, আ, ক, খ, শেখানো শুরু করে প্রাইভেট টিউটর দিয়ে। এরপর ঝুলে কে.জি. স্কুল নামের বিশাল ব্যাগের বোঝা। যেখানে শিশুদের পড়ালেখায় সার্বক্ষনিক ব্যস্ত রাখার পাশাপাশি শিশুকাল থেকেই মানসিক চাপে রাখা হয়। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে প্রথম শ্রেণীতে তিনটি পাঠ্য বইয়ের বিপরীতে এসব বিশেষায়িত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে থাকে ডজন খানেক বই আর পড়াশোনার বাড়তি চাপ। এসব বইয়ের পড়া শিখন আর মুখস্ত করার চাপে রীতিমতো খেলাধূলার করার সময়ও থাকে না শিশুদের। আমরা ঠিক এমনই বিনিয়োগ করে যাচ্ছি আমাদের শিশুদের জন্য। তবে এর কিছু ব্যতিক্রমও আছেন; তাদের সাধুবাদ জানাই।

NewsDetails_03

মানুষ হিসেবে আমরা সকলেই এক সময় একজন শিশু ছিলাম। শৈশব, কৈশোর, যৌবনকাল পার করে অনেকেই বৃদ্ধ হয়েছি। আমাদের মাঝ থেকেই ভালো মনের মানুষের সৃষ্টি যেমনি হচ্ছে, তেমনি ‘খারাপ’ মানুষেরও সৃষ্টি হয়েছে। শিক্ষক, চিকিৎসক, গবেষক, লেখক, কবি-সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী, কৃষিবিদ, আমলা, সন্ত্রাসী, লুটেরা ও মুনাফাখোর সব আমাদের মানুষ থেকেই সৃষ্টি হচ্ছে। আবার কেউ কেউ শ্রমিক-কৃষক-কর্মচারী হিসেবে প্রতিনিয়ত উৎপাদন করে যাচ্ছি। আবার কেউ কেউ শোষণ, বৈষম্য করছি, পুঁজিপতি হচ্ছি। সব কিছুরই পেছনে আমরা। কেউ রাজনীতির নামে, কেউবা ধর্মের নামে নির্যাতন-নিপীড়ন করছি। আবার আমরাই এসবের প্রতিবাদ করছি, ঘৃনা জানাচ্ছি। আমাদের মধ্যে দুই ধরণের মানুষের ভেদাভেদ হয়ে আছে। একজন শোষক, আরেকজন শোষিত। কিন্তু আমরা সবাই তো মানুষই, সবাই তো কৈশোর-শিশুকাল পার করে এসেছি। তাহলে কেন আমরা বিভেদকারী হচ্ছি, শোষক হচ্ছি, লুটেরা হচ্ছি?

প্রত্যেক মানুষই চান তাঁর সন্তান ভালো মনের মানুষ হোক। জনগণ-দেশের কল্যাণে এগিয়ে যাক। কিন্তু বেশির ভাগ মানুষই এখন আমরা সন্তানের বেড়ে ওঠার দিকে নজর দেই না। কেবল স্বাস্থ্যে, দেহে সুঠামে বিকশিত হয়ে বাড়ন্তই সন্তানের সঠিক বেড়ে ওঠা হয় না। আপনার-আমার শিশুকে বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে সবচেয়ে মুখ্য ভূমিকার থাকে পরিবার তথা বাবা-মায়ের। মানুষ প্রথমত তাঁর পরিবার থেকে কথা বলা, নিজের ভাষা শেখা, আত্মীয়-স্বজন ও চারপাশ সম্পর্কে জানতে-চিনতে থাকেন। আমরা যদি মানুষের মধ্যকার বিভেদ শেখাই, সমাজের বৈষম্যকে মেনে নিতে শেখাই তাহলে আমরা সন্তানও সেভাবেই বড় হবে। ধর্মীয়, জাতিগত ভেদাভেদ হিংসা শেখালে তারাও সেইভাবে বড় হবে। প্রত্যেক জাতি, ধর্মের মানুষের সমান দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে যদি তারা বড় না হয় তখন তারাও ওই ভেদাভেদ নিয়ে বড় হয়। একটা সময়ে এসে তারা ওইসব কাজে নিজেদের জড়িত করে তুলে। আগেই বলেছি মানুষের মধ্যে ভালো-খারাপ দুই ধরণেই আমরাই আছি। আমরাই এটি সৃষ্টি করেছি, করছি নানান ভাবেই।

প্রাথমিক শিক্ষার একটি উদাহরণ না দিলেই নয়। বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষায় প্রথম শ্রেণী এবং দ্বিতীয় শ্রেণীতে তিনটি পাঠ্যবই থাকে; বাংলা, গণিত ও ইংরেজি। তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত যোগ হয় আরও তিনটি বই; সাধারণ বিজ্ঞান, সামাজিক বিজ্ঞান ও ধর্মীয় শিক্ষা বা ধর্ম শিক্ষা। প্রাক-প্রাথমিক থেকে শিশুরা সবাই একসঙ্গে প্রত্যেকটা ক্লাস করলেও তৃতীয় শ্রেণীতে এসে যখন ধর্মীয় শিক্ষার ক্লাস আসে তখন ধর্মভিত্তিক শিক্ষার্থীরা আলাদা হয়ে যান নিজেদের ক্লাস করার জন্য। এই শিশুরা এতদিন নিজেদের মধ্যে ধর্মীয় পার্থক্যের বিষয়টি বুঝে উঠতে না পারলেও যখন তারা ধর্মের ক্লাস পান তখনই তারা এই ধর্মীয় ভেদাভেদ সম্পর্কে বুঝতে শুরু করেন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ালেখার সময়ে আমাদের এই একই অনুভূতি হয়েছিল যে আমরা দেখতে শুনতে কিংবা সব দিক থেকে একই রকম হলেও ধর্মের দিক থেকে বিভেদ থাকে। আমি আর আমার সব সহপাঠী এক নয়; আমাদের পার্থক্য রয়েছে। এর প্রভাবও কিন্তু আমাদের শিশু বিকাশেও পড়ে। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার গুনগত-কাঠামোগত যে সব সংস্কার দরকার; তন্মধ্যে আমরা মনে করি এই বিষয়টি নিয়েও ভাবনার প্রয়োজন জরুরি।

একটা সময়ে দেশে খেলাঘর আসর নামের একটি সাড়া জাগানো শিশু সংগঠন ছিল জেলায় জেলায়। এখন বেশির ভাগ জেলায় এখনো নামকাওয়াস্তে খেলাঘর আসর থাকলেও কার্যক্রম নেই। এছাড়া শিশু-কিশোর মেলাসহ বিগত দিনে বিভিন্ন সংগঠন গড়ে ওঠলেও এসব সংগঠন শিশুর বিকাশে ভূমিকা রাখছেনা কিংবা রাখতে পারছে না। বছরে দুই একটি কর্মসূচি পালনের মধ্যে কার্যক্রম সীমাবদ্ধ থাকে, রাখে। এছাড়া শিশুদের জন্যও কাজ করে থাকে বিভিন্ন এনজিও এবং আই-এনজিও। আন্তর্জাতিক ও দেশীয় এসব উন্নয়ন সংস্থার মধ্যে রয়েছে ইউনিসেফ, শিশু অধিকার ফোরাম, জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরাম, সিনারগোস বাংলাদেশ, সেভ দ্য চিলড্রেন, এডুকো, অপারাজেয় বাংলাদেশ, জাতীয় প্রতিবন্ধী ফোরামসহ বিভিন্ন শিশু সংগঠন ও সংস্থা। তবে এসব উন্নয়ন সংস্থার কার্যক্রম প্রান্তিক পর্যায়ে তেমন পৌঁছায় না।

শুরুর দিকে বলছিলাম ইউটিউব আর ইন্টারনেটের কথা। বলেছিলাম বর্তমান ও এক দশক আগেকার সময়ে শিশুদের বেড়ে ওঠার কথা। আমাদের শিশুরা এখন আর আগের মতো বেড়ে উঠতে পারছে না কারণ আমরাও তাদের সেভাবেই বেড়ে ওঠাতে চাইছি না। আমরা মর্ডাণ কিংবা সব কিছু ডিজিটালভাবে গড়ে তুলতে গিয়ে শিশুর সৃজনশীল বিকাশকে ডিজিটালাইজড করে ফেলেছি। সৃজনশীল বিকাশে বাধাগ্রস্ত করছি গভীরভাবে না ভেবে, না বুঝেই। তাই আপনার সন্তানকে খেলার সুযোগ করে দিন, সহপাঠী বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে মেশার সুযোগ করে দিন। গান-কবিতা, নাচ, আঁকাআঁকিসহ বিভিন্ন ধরণের সৃজনশীল কাজ শিখনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করুন। জিপিএ-ফাইভ নির্ভর একটি ফল আকাক্সক্ষার পরিবেশ তৈরি করে শিশুর সৃজনশীল বিকাশে বাধাগ্রস্ত করবেন না। প্রতিপাদ্য বিষয়ের সূত্র ধরেই শেষ কথাটি বলতে চাই, শিশুর জন্য বিনিয়োগ করুন, সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য। সাম্যের ভবিষ্যতের জন্য। যে ভবিষ্যৎ প্রাণ-প্রকৃতি, জীব-বৈচিত্র্য থেকে শুরু সর্বোপরি পৃথিবীর মঙ্গলের জন্য অবদান রাখবে।

প্রান্ত রনি
লেখক: সাংবাদিক ও আলোকচিত্রী

আরও পড়ুন