হতভাগা ম্রো সন্তানদের পড়ালেখার খরচ কে যোগাবে এখন?

রুমার নির্মম ৫ হত্যাকান্ড

NewsDetails_01

বান্দরবানের রুমায় গালেঙ্গ্যা ইউনিয়নের দুর্গম আবু পাড়া কারবারী (পাড়াপ্রধান) লকরুই ম্রো ও তাঁর ৪ ছেলেকে কুপিয়ে হত্যা করার পর নিহতদের সন্তানদের পড়ালেখা বন্ধ হয়ে গেছে। হতভাগা এসব সন্তানের পড়ালেখা চালিয়ে নেয়ার খরচ কে দিবে এখন? পিতার মুত্যুর পর, কে পড়ালেখার খরচ যোগাবে, এসব চিন্তায় ঘুমাতে পারিনা। এসব কথা জানিয়েছে তাংপয় ম্রো (১৬)। সে পাড়া প্রধান নিহত লকরুই ম্রোয়ের সেজ ছেলে নিহত লেনঙি ম্রো’র চার সন্তানের মধ্যে সবার বড়।

বান্দরবানে সুয়ালক ম্রো আবাসিক বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত এবং কোভিড-১৯ করোনা ভাইরাসের প্রতিরোধে বিদ্যালয় বন্ধ থাকায় নিজ পাড়ায় এসে বাড়িতে ছিল।

তাংপয় ম্রো জানায়, বাবাকে মেরে ফেলা হয়েছে। এজন্য তার মতো ছোট আরও ২ ভাই ও ১ বোনও পড়ালেখা করার সুযোগ হবেনা, আমরা এখন অনাথ, বাবা নেই। মায়ের সাথে ঘরে থাকতে হবে। মা আমাকে আর ছাড়বে না। তাংপয়ও ভাইবোনকে ছাড়তে চায়না। পড়ার ইচ্ছা আছে, আমাদের পড়ালেখা খরচ চালাবে কে? মা খরচ বহন করতে পারবেনা। আজ সোমবার (২৮ ফেব্রুয়ারী) দুপুরে মুরুং বাজারে এক দোকানে কথা হয় তাংপয় ম্রো’র সঙ্গে। তখন এসব কথা জানিয়েছে সে।

তাংপয় ম্রো বলেন,বাড়িতে আসলে আমাকে কাজে নিয়ে যেতে চইতো না, আমি কষ্ট পাব বলে। শুধু বলত, ভাল করে পড়ালেখা শিখতে। তাই আমরা ৪ ভাই- বোন সবাই পাড়াতে ও বাইরে সবাই পড়ালেখা করছি।

পিতাকে হত্যার সম্পর্কে বলতে গিয়ে তার চোখের জলে চোখ টলমল করছিল, দুচোখ বেয়ে ঝরে পরছলো অশ্রুধারা। এক হাতে জল মুছে ও বলেন, তার বাবাকে প্রথমে ধারালো (জুম কাটার) ধারালো দা দিয়ে মাথায় কোপ দিয়েছিল, তখন বাবা চিৎকার করেনি। আরেকজন কুপিয়েছে কানের নীচে। তারপর ঘরের সামনে থেকে টেনে নিয়ে গেছে তারা।

প্রসঙ্গত; রুমার গালেঙ্গ্যা ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ড দুর্গম আবু পাড়ায় ২৪ ফেব্রুযারি রাতে পাড়াপ্রধান লকরুই ম্রো ও তাঁর ছেলেসহ মোট ৫ জনকে কুপিয়ে হত্যা করে পাড়াবাসী। দীর্ঘদিনের তন্ত্র মন্ত্রের জাদুর বানে পাড়াবাসীকে কষ্ট দিয়ে মেরে ফেলার অভিযোগ এনে এ হত্যার ঘটনা ঘটে।

NewsDetails_03

এঘটনার খবর পেয়ে রুমা থানার এসআই আমিনুল ইসলাম ও এসআই আতিকুলের নেতৃত্বে পুলিশের একটি দল গত ২৫ ফেব্রুয়ারি লাশ নিহতদের উদ্ধার করে। ওই রাতে আবু পাড়ার বাসিন্দা ২২ জনকে আটক করে পুলিশ। গত ২৬ ফেব্রুয়ারি আবু পাড়াপ্রধানের নিহত সেজ ছেলের স্ত্রী বাদী হয়ে পরিকল্পিত খুনের অপরাধে ফৌজদারি দন্ডবিধি ৩০৪/৩৪ ধারায় একটি মামলা দায়ের করেন।

রুমা থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও সহকারি পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আবুল কাসেম চৌধুরী বলেন, এজাহারভূক্ত আসামী ২২জনকে জেলায় জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্টেটের আদালতের মাধ্যমে জেল হাজতে প্রেরণ করেন এবং নিহতের ময়না তদন্তের জন্য জেলা সদর হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে।

এদিকে নিহতের পরিবারের লোকজন জানায়, বিদ্যালয়ের পড়ুয়া সন্তানদের আর পড়তে ঘরের বাইরে পাঠাবেনা। নিহত মেনওয়াই ম্রো’র স্ত্রী কাইপয় ম্রো বলেন, তাঁর স্বামীকে পাড়ার লোকজন মেরে ফেলেছে। সন্তানদের পড়ালেখার টাকা কে দেবে? আমার সাথে কাজ করাব জুমে। আর কোনো কথা নেই তার।

সূত্রমতে, আবু পাড়ার কারবারীর নিহত ৪ সন্তানের মধ্যে সবার বড় তুংতুই ম্রো’র কোনো স্ত্রী ও সন্তান নেই। সবার ছোট রিংরাও ম্রো অবিবাহিত ছিল।

মেজ ছেলে নিহত লেংঙি ম্রো’র চার সন্তানের মধ্যে দুইজন মেয়ে ও দুইজন ছেলে। তার মধ্যে এক ছেলে, এক মেয়ে বান্দরবানে পড়ালেখা করে এবং বাকী দুইজন পাড়ার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ছে।
সেজ ছেলে নিহত মেনওয়াই ম্রো’র আলাদা করে পরিবার হয়নি। স্ত্রী সস্তান নিয়ে তাঁর পিতার বাড়িতে যৌথ পরিবারে বসবাস করতেন। তাঁরও রয়েছে চার সন্তান। এরা হলো, ইপয় ম্রো(১৩), ঙানচ্যং ম্রো(১১), সিংপাত ও সিংপয় ম্রো হচ্ছে জমজ। এদের বয়স আট বছর।

এদিকে গালেঙ্গ্যা ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ডের স্থানীয় মেম্বার ঙানরাও ম্রো(৪৭) বলেন, তাঁর ওয়ার্ডের এই আবু পাড়ায় ২১ পরিবারের বসবাস। বেশির ভাগ যৌথ পরিবার। এ পাড়ার লোক সংখ্যা নারী-পুরুষ ও শিশু কিশোর মিলে ১৫০জনের একটু বেশি। তার মধ্যে কারবারী ও তাঁর চার ছেলেসহ ৫ জনের হত্যার মামলায় এর মধ্যে ২২জন গ্রেপ্তার হয়ে জেল হাতে রয়েছে। ১৬টি পরিবারের মধ্যে কোনো কোনো পরিবার থেকে দুইজনও গ্রেপ্তার আছে। বলতে গেলে পাড়াটি অনেকটা পুরুষ শূণ্য হয়ে পড়ছে। এ অবস্থায় পাড়ায় নিহত পরিবারের সাথে জেলে যাওয়া সন্তানেরাও পড়ালেখা করতে পারবে বলে মনে হয়না বলে জানিয়েছেন ইউপি মেম্বার ঙানরাও ম্রো।

তিনি আরো বলেন, সংঘটিত হত্যা ঘটনা নিয়ে পাড়ার লোকজনের মধ্যে এধরণের ঘটনা যাতে না ঘটে, বিষয়টি নিয়ে মৌজা হেডম্যান, ইউপি চেয়ারম্যান সহ এলাকার ম্রো সমাজের নেতাদের নিয়ে আবু পাড়ায় আলোচনা সভা করার উদ্যেগ নেয়া হয়েছে।

আরও পড়ুন