আমি ও আমাদের সাংবাদিকতা

NewsDetails_01

আমি দায়িত্ব নিয়েই বলছি, খাগড়াছড়িতে কেউ অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে যে কোন মিডিয়ায় (সাংবাদিক হলে অবশ্যই গণমাধ্যম) প্রতিবেদন করলে; তাঁর ওপর কোন ঝড়-ঝাপটা আসলে ‘খাগড়াছড়ি সাংবাদিক ইউনিয়ন’ অতীতের মতো সবসময় সাহসী সাংবাদিকতার সাথে থাকবো। এখন খাগড়াছড়িতে আমরা যে তালের সাংবাদিকতা করছি, এটাকে হাততালি সাংবাদিকতা বলা যেতে পারে। তবে দুই-একজন যে ভালো কিছু করছে না তাও নয়। আবার কেউ কেউ প্রতিবেদনের নামে অন্য কিছুও করছে, করার অপচেষ্টা করছে। তাঁদের জন্য বাকীদের বদনাম হচ্ছে। ছোটশহর, জেলাজুড়েই নিয়মিত সাংবাদিকদের সংখ্যা কম। মিটিং-ওয়ার্কশপ আর দাওয়াতে দেখা মেলা হঠাৎ সাংবাদিক-ইলেকশন সাংবাদিক-পরীক্ষার হল সাংবাদিক-ব্যবসায়ী সাংবাদিক; এসব অনিয়মিত সাংবাদিকদের আমি কাউন্ট করছি না।

সাংবাদিকরা স্থায়ী ব্যবসা-বাণিজ্য করলে আমি দোষের কিছু দেখি না। কিন্তু সাংবাদিকতার নামে মৌসুমী ব্যবসায়ী-ভাসমান ব্যবসা-অস্থায়ী ব্যবসা পেশাকে বিব্রত করে। নোংরা উদাহরণ তৈরি করে। সৎ সাংবাদিকতা কম করলেও মানুষ মানবে-বুঝবে এবং প্রয়োজন পড়লে সম্মান করবে। অনেক বেশি সাংবাদিকতা করলাম, সাথে আরো বেশি অসৎ সাংবাদিকতা করলাম, তাতে অন্য সহকর্মীরাও ঝুঁকিতে পড়বে। অপরাধী মন সব সময় সঙ্কোচ নিয়েই চলে। সাংবাদিকতা করে আমরা কে কতো টাকা বেতন পাই কী পাই না, কে কিভাবে চলি; এটা সবার জানা। এখানে অহংকার বা ভাব ধরার কিছুই নেই। তবে সামনের সময় ভালো নয়। সাপ্তাহিক সাংবাদিকতা-মৌসুমী সাংবাদিকতা-হঠাৎ সাংবাদিকতা-উড়ে আসা সাংবাদিকতা-জুড়ে বসা সাংবাদিকতা-সহকারি সাংবাদিকতা- জনবল সাংবাদিকতা- যাঁকে-তাঁকে সাংবাদিক বানানো সাংবাদিকতা ধেয়ে আসছে। এই অবস্থা কখনো কারো জন্য সুখকর হবে না।

আমরা যাঁরা কয়েক দশক পেশায় পার করা মানুষ এবং আমাদের মতো আরো যাঁরা অনুগামী, তাঁদের জন্য চারপাশে আমি অশনি সঙ্কেত দেখতে পাচ্ছি। নিয়মিত- পেশাদার সাংবাদিকদের জীবন-মান-সম্মান এবং পেশা ও জীবিকার স্বার্থ ভেবে এখনিই ঐক্যবদ্ধ হওয়া দরকার। দল-মত (স্বাধীনতা বিরোধী মতাদর্শ বাদে) না ভেবে, পদ-পদবীর কথা না ভেবে, সাংবাদিক সংগঠনের নেতৃত্ব কুক্ষিগত করার মানসিকতা পরিহার করে, সাংবাদিক সংগঠনে বার বার পদে থাকার মানসিকতা পেছনে ফেলে, সাংবাদিক সংগঠনগুলোর সদস্যভূক্তিকে উদার করে; সবার উচিত একই ছাতার নিচে আসা। এখনই সময় ঐক্যবদ্ধ হবার, এখনই সময় অনিয়মের বিরুদ্ধে জেগে উঠার। খাগড়াছড়িতে চারপাশে উন্নয়নের নামে দিনে-দুপুরে কতিপয় প্রভাবশালী মানুষের টাকা কামানোর যে অসুস্থ-অস্বাভাবাবিক উল্লস্ফন দেখছি, এগুলো সহ্য করার মতো নয়। দুয়েকজন সাংবাদিককে নামমাত্র কাজ দিয়েছে বলে বেড়িয়ে বেড়িয়ে এই ব্যাটারা পুকুরচুরি করছে। সাংবাদিকতা নিচে নামতে নামতে এমন জায়গায় নেমেছে, কোন অফিসে গেলে পরিচিতরা বলেন, ‘কী, বিজ্ঞাপনের জন্য এসেছেন?’। তার মানে আমাদের কিছু কিছু লোক শুধুমাত্র বিজ্ঞাপনের জন্যই ঘুরঘুর করে।

NewsDetails_03

একজন সাংবাদিক কোন অফিসে গেলে আগে দেখতাম, অফিসের সব লোকজন ফিসফিস করতো, সাংবাদিক আসছে বলে বলে। এইতো ‘২০০০’ সালের আগে ও পরে যখন ‘প্রতিদিন খাগড়াছড়ি’র প্রধান প্রতিবেদক ছিলাম। শ্রদ্ধেয় তরুণ ভট্টাচার্য্য মহোদয়ের অ্যাসাইনমেন্ট কাভার করতে গেলে অফিস প্রধান আগেই বলে দিতেন, সব তথ্য দেবো তবে আমাকে একটু দেখতে হবে। ভুলভ্রান্তি হলে একটু রয়েসয়ে লিখবেন। সেই সাংবাদিকতা কই গেলো? ‘২০০১-২০০৬’ ক্ষমতায় ছিলো যাঁরা, তাঁরা গণমাধ্যমকে ভয় করতো, এড়িয়ে চলতে চাইতো, গুটিকয়কে সুবিধা দিতো; কিন্তু মূলধারার সাংবাদিকতা নিয়ন্ত্রণে নিতে পারেনি অপেক্ষাকৃত তরুণ সাংবাদিকদের কারণেই। সেই তারুণ্য কই গেলো? বরং মাঝে মাঝে হতাশ হই যখন দেখি, সবচেয়ে সম্ভাবনাময় ছেলেটি এক-দুটি ভালো প্রতিবেদন করার পর, চলাফেরায় কেমন জানি চেইঞ্জ চোখে পড়ে। বছরে দু’বার/ তিনবার গাড়ির মডেল পাল্টায়। মনে করতে থাকে ও যা লিখছে বা করছে; অতীতে মনে হয় কেউ/ কেউ-ই করেনি। সবকিছু ও বা ওরাই প্রথম করছে। তারপর পাল্টাতে পাল্টাতে দেখি, সবচেয়ে সাংবাদিক- সাহসী কলমযোদ্ধা হয়ে উঠার মতো সব সম্বাবনা আর সাংবাদিকতার দিক থেকে তার মনোযোগ হারিয়ে যায়। সরকারি অফিসে অফিসে দৌঁড়ঝাপ, কারণে অকারণে সৌজন্য বিজ্ঞাপনের তদবির, ক্ষমতাবানদের ছাপোষাদের সাথে উঠাবসা, জমি-গাড়ি…….আরো কতো কিছু….। অযোগ্য আত্মীয়-স্বজনের চাকরি-বদলি-তদবির বাণিজ্যে সদাব্যস্ত এসব মহা সাংবাদিকের অত্যাচরে মূলধারার সাংবাদিকতার গতিধারা আজ চরম ব্যাহত।

একসময় খাগড়াছড়ির সব সৃজন ও কল্যাণকর কাজে সাংবাদিকরাই নেতৃত্ব দিতেন। জেলা পরিষদ-প্রশাসন; সব জায়গাতেই সাংবাদিকদের অবস্থান ছিলো অনেক উপরে। জনপ্রতিনিধি-রাজনীতিবিদ-সরকারি অফিসার; সবাই সাংবাদিকদের সমীহ করতেন। গুরুত্ববহ সব সভা-সমাবেশে সাংবাদিক সংগঠনের নেতাদের জন্য চেয়ার সংরক্ষিত থাকতো। সাংবাদিকতার চরম বিশৃঙ্খলার কারণে এখন অনেক অফিস তাদের নানা কর্মসূচিতে সাংবাদিক ডাকতেও ভয় পান। একজন ডাকলে দশজন যান। সাংবাদিকতা দূরে অনেক দূরে অথবা মাত্রই সাংবাদিকতাই পা দিলো; এই দুই শ্রেণীকেই দাওয়াত দেওয়াই হলো না কিন্তু তাঁরা গিয়ে বসে থাকেন প্রয়োজনীয়দের চেয়ারে। কথা বলেন অবিরল বুঝে বা না বুঝেই। আর যদি কোথাও টাকার গন্ধ থাকে তাহলে সে সুঘ্রাণে মাতোয়ারা হয়ে যায় জেনো পুরো জেলায়। উপজেলা থেকেও ছুটে চলে আসেন দায়িত্ববান জেলা বা আঞ্চলিক প্রতিনিধিও। কীসব উদ্ভট অনলাইন আর পত্রিকার নাম-পরিচয় দেয়; ঠিকমতো শুনে, বুঝে উঠতেও বেশ কতোক্ষণ সময় নিতে হয়।

খাগড়াছড়ির সাংবাদিকতা প্রাণ ফিরে পাবে নিশ্চয়ই। হতাশার মাঝেই আশার আলো সঞ্চার হয়েছে যুগে যুগে। নিশ্চয়ই আমি বা আমাদের চেয়ে শিক্ষা-দীক্ষায়-জ্ঞানে প্রযুক্তিতে উন্নত-সম্পন্ন আরো অনেক নতুনমুখ সাংবাদিকতায় আসবে। পাল্টে যাওয়া জীবন আর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই)-সহ সর্বশেষ আবিষ্কারের সাথে তাল মিলিয়ে তাঁরা সূচনা করবেন, নতুন ধাঁচের সাংবাদিকতা। সবকিছুর ওপর জরুরী প্রশ্ন-মৌলিক চাওয়া, সাংবাদিকতার ঐক্য। পেশাদার-নিয়মিত সাংবাদিকতার ঐক্য আজ সময়ের দাবি। থামার আগে আরো একবার বলি, সাহসী সাংবাদিকতার পাশে আছি-থাকবো এবং অনিয়মের বিরুদ্ধে যে কলম জেগে উঠবে, সে কলমের কালি আমিই যোগান দেবো।

জয় বাংলা।
প্রদীপ চৌধুরী: সভাপতি, খাগড়াছড়ি সাংবাদিক ইউনিয়ন (কেইউজে/ রেজি: নং- চট্ট ২৮০৮)।

আরও পড়ুন