জটিল সমিকরণে বান্দরবানের নির্বাচন কেন্দ্রিক রাজনীতি

NewsDetails_01

বান্দরবান ৩০০ নং আসনে আওয়ামী লীগ থেকে বীর বাহাদুর উশৈসিং এমপি’র দলীয় মনোনয়ন অনেকটা নিশ্চিত হলেও বিএনপির মনোনয়ন কে পাচ্ছেন, আর কোন দল কাকে সমর্থন দিচ্ছেন তা নিয়ে নেতাকর্মীদের বিশ্লেষনের যেন শেষ নেই। অন্যদিকে জেলার রাজনীতির মাঠের গুঞ্জন আর সমিকরণ নিয়ে এখন থেকেই কখনও সরব, কখনও নিরবে নির্বাচন কেন্দ্রিক রাজনীতি জমে উঠেছে। আর এ নিয়ে এস বাসু দাশ এর বিশেষ প্রতিবেদন।

সূত্রে জানা যায়, ১৯৯৬ সালের সংসদ নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী হন সাচিং দ্বন্দ্ব জেরী। পাল্টা হিসেবে রাজ পরিবারের আরেক অংশ তাঁর বিপক্ষে মাঠে নামে। ২০০১ সালে সাচিং প্রু জেরী ও মাম্যাচিং দুজনই সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামেন এবং দুজনই বীর বাহাদুরের কাছে পরাজিত হন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি দলীয় মনোনয়ন পান মাম্যাচিং। তখন সাচিং প্রু নির্বাচন না করলেও পেছন থেকে কলকাঠি নাড়ার কারণে মাম্যাচিং মাত্র ৮শ ৫৩ ভোটে বীর বাহাদুরের কাছে হেরে যান।
২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের একজন শক্তিশালী বিদ্রোহী প্রার্থী থাকলেও বীর বাহাদুর পঞ্চমবারের মতো তাঁর ধারাবাহিক বিজয় অক্ষুন্ন রাখতে সক্ষম হন এবং রাজনীতির মাঠে সময় দিয়ে, জনগনের আরো কাছে গিয়ে নিজেকে আরো জনপ্রিয় হিসাবে জানান দেন।
জেলা বিএনপির বর্তমান কমিটি ম্যামাচিং গ্রুপের থেকে হওয়ার কারনে, বান্দরবানে বিএনপিকে সক্রিয় রাখতে স্বাভাবিক ভাবে এবার সাচিং প্রু জেরীকে কেন্দ্র থেকে মনোনয়ন দেওয়া হতে পারে, অন্যদিকে লবিং এর জোর ও বর্তমান কমিটির তৃনমূলের শক্তির কারনে মাম্যাচিংও দলীয় মনোনয়ন পেলে অবাক হওয়ার কিছুই থাকবেনা। দলীয় মনোনয়ন যাকেই দেওয়া হোকনা কেন দলের মধ্যে কোন বিরোধীতা থাকবেনা বলে জানান বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা। আর বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহন করলে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রার্থীর মধ্যেই মূল লড়াই হলেও দুই দলকেই এবার ভিন্ন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে।

►বিএনপির নেতারা যা বলেন:
এই ব্যাপারে সাবেক ছাত্রদল নেতা জাহাঙ্গীর আলম (জেরী গ্রুপ) পাহাড়বার্তাকে বলেন, ধানের শীষ প্রতিক যে পাই, তার পক্ষে আমরা কাজ করবো, অতিতের নির্বাচনে বিরোধীতা থাকলেও আগামী সংসদ নির্বাচনে সেই ধরণের কোন বিরোধ থাকবেনা।
লামা উপজেলা বিএনপির সভাপতি মো. আমির হোসেন পাহাড়বার্তাকে জানান, আগামী সংসদ নির্বাচনে বিএনপি থেকে যাকেই প্রার্থী দেওয়া হোকনা কেন, তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করবেন।
লামা পৌর বিএনপির সভাপতি (মাম্যাচিং গ্রুপ) আবদুর রব বলেন, প্রার্থী যাকেই দেয়া হউক না কেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীকে জেতাতে এক সাথে কাজ করব।
বান্দরবান জেলা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক শিমুল দাশ পাহাড়বার্তাকে বলেন, বিগত সময়ে মাঠে মাম্যাচিং ছিলেন, তাই দলীয় মনোনয়ন মাম্যাচিং এই পাবেন, অন্য কাউকে দিলে কেউ মেনে নেবেনা।
বান্দরবান জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক জাবেদ রেজা পাহাড়বার্তাকে বলেন, যদি বিএনপি নির্বাচনে যায়, তাহলে প্রার্থী যাকেই দেওয়া হোকনা কেন, আমরা ঐক্যবদ্ধ ভাবে কাজ করবো। কোন বিদ্রোহী প্রার্থী থাকবেনা।

►মিটবেনা বিএনপির বিরোধ:

আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জেলা বিএনপিতে বিরোধ যেকোন সময়ের চেয়ে বেশি চাঙ্গা হয়ে উঠবে, হয়তো তা প্রকাশ্যে, নয়তো অপ্রকাশ্যে। সাচিং প্রু জেরী ও মাম্যা চিং সাংগঠনিক তৎপরতা চালাচ্ছেন আলাদা আলাদা ভাবে, নির্বাচনে মনোনয়ন পেতে দুইজনেই বিগত সময়ের মতো কেন্দ্রে লবিং করছেন।
জেলা বিএনপির শীর্ষস্থানীয় একটি সূত্র জানায়, মাম্যাচিং যেহেতু জেলা বিএনপির সভাপতি সেক্ষেত্রে ক্ষোভ প্রশমনে এবার সাচিং প্রু জেরীর মনোনয়ন অনেকটা নিশ্চিত। ফলে মাম্যাচিং গ্রুপ বিদ্রোহী প্রার্থী দিয়ে তাঁর বিপক্ষে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। অথবা অন্য কোনো প্রার্থীকে গোপনে সমর্থন দিতে পারে, এক্ষেত্রে ক্ষোধ গোপনে বীর বাহাদুরকে বেছে নিতে পারেন। বিএনপি থেকে মাম্যাচিং বা সাচিং প্রু জেরী যাকেই মনোনয়ন দেওয়া হোকনা কেন, বিএনপি ঐক্যবদ্ধ ভাবে নির্বাচন করতে পারবেনা।
এই ব্যাপারে সাবেক ছাত্রদল নেতা জাহাঙ্গীর আলম (জেরী গ্রুপ) পাহাড় বার্তাকে বলেন, ধানের শীষ প্রতিক যে পাই, তার পক্ষে আমরা কাজ করবো, অতিতের নির্বাচনে বিরোধীতা থাকলেও আগামী সংসদ নির্বাচনে সেই ধরণের কোন বিরোধ থাকবেনা।

NewsDetails_03

►আসছে ৩য় শক্তি ?
কোন কারনে সাচিং প্রু জেরী যদি দলীয় মনোনয়ন বঞ্চিত হন সেক্ষেত্রে সাচিং প্রু জেরীকে মাঠে নামাতে পারেন আওয়ামী লীগ বিরোধী জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি প্রসন্ন কান্তি তংচঙ্গ্যা ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক কাজী মুজিবর রহমান। আর সেই মিশনকে সমানে রেখে সাচিং প্রু জেরীর সাথে একাধিকবার কাজী মুজিবুর রহমান বৈঠক করেছে বলে জানা গেছে। সব ঠিক থাকলে গতবার পার্বত্য চট্টগ্রাম জন সংহতি সমিতি আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী প্রসন্নকে সমর্থন করলেও এবার জনসংহতি সমিতি এই ৩য় শক্তিকে সমর্থন দেওয়ার বিষয়ে ইতিমধ্যে একাধিক পারস্পরিক বৈঠক করেছে, একাধিক সুত্রে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। দলীয় মনোনয়ন না পেলে সাচিং প্রু জেরীকে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) প্রার্থী হিসাবে নির্বাচনের মাঠে নামানোর জন্য অনেকটা অগ্রসর হয়েছে আওয়ামী লীগ বিরোধী শিবির।

►আরো সক্রিয় হবে আওয়ামী লীগ:

সংগঠন বিরোধী বিভিন্ন কর্মকাণ্ড ও নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে মনগড়া সিন্ধান্ত নিয়ে দলীয় সুনাম ক্ষুন্ন করায় ২০১৩ সালের ২রা ডিসেম্বর বান্দরবান জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি প্রসন্ন কান্তি তংচঙ্গ্যাকে বহিষ্কার করা হয়। সর্বশেষ দলীয় সংসদীয় কমিটির সিদ্ধান্ত অমান্য করে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী নির্বাচনে অংশগ্রহন করেন। ২০১৫ সালের জুন মাসে জেলা ছাত্রলীগের সম্মেলনে হামলার অভিযোগে কাজি মুজিবুর রহমানসহ ২২ নেতাকর্মীকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। আওয়ামীলীগের রাজনীতিতে প্রসন্ন-মুজিব দুইজন দুই মেরুর বাসিন্দা হয়ে একে অপরের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহন করলেও গত বছরের ৯ ডিসেম্বর কক্সবাজারের একটি হোটেলে বহিষ্কৃত জেলা আ’লীগের সাবেক সভাপতি প্রসন্ন কান্তি তংচঙ্গ্যা ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক কাজি মুজিবুর রহমান গোপন বৈঠক করেন এবং বীর বাহাদুরের বিরুদ্ধে প্রার্থী দাড় করানোর জন্য প্রস্তুতি নেন,যা এখনও অব্যাহত আছে।
এই ব্যাপারে জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ন সাধারণ সম্পাদক লক্ষী পদ দাশ পাহাড়বার্তাকে বলেন, প্রসন্ন, মুজিব দলে থাকা অবস্থায় আমরা একটি উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে জয়ী হতে পারিনি। তাদের বহিষ্কারের পর ৩৩টি ইউনিয়নের মধ্যে ২৯টিতে আওয়ামী লীগ জয়ী হয়,২টি পৌরসভায় জয়ী হয়েছে, তাদের যদি কেউ নির্বাচনে প্রার্থী হয় তাহলেও বীর বাহাদুরের আগামী নির্বাচনে জয়ী হতে কোন প্রভাব পড়বেনা।
এদিকে দলের বিরুদ্ধে ও দলের প্রার্থীর বিরুদ্ধে সব ষড়যন্ত্র রুখে দিতে গত ২৬ জুলাই বান্দরবান শহরের অরুণ সারকী টাউন হলে অনুষ্ঠিত জেলা আওয়ামী লীগের বিশেষ বর্ধিত সভায় তৃনমূলের দাবীর প্রেক্ষিতে সর্ব সম্মতিক্রমে এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় এবং বিগত সময়ের মতো আগামী নির্বাচনেও যেকোন মূল্যে দলের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীদের প্রতিহত করা হবে বলে ঘোষনা করা হয়। অন্যদিকে একসময়ের রাজনৈতিক মিত্র পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করছে দলটি।
বান্দরবান জেলা আওয়ামীলীগের সহ- সভাপতি একে এম জাহাঙ্গীর পাহাড়বার্তাকে বলেন, দলে কোন সংকট নেই। অতীতে দলের সাথে বেইমানী করে অনেকে প্রার্থী হলেও তারা পারেনি, তারা সাকসেস হয়নি। সামনেও কেউ নির্বাচনে দাড়ালে হবেনা এবং আগামী নির্বাচনে বীর বাহাদুর এই নির্বাচিত হবেন।

►কোন ভূমিকায় জেএসএস ?
আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতা মং প্রু মার্মা অপহরণ, আর এই ঘটনায় আসামি হওয়ায় বান্দরবান জেলা জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) এর শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা ঘরছাড়া হয়। বিগত উপজেলা নির্বাচনে পার্বত্য চট্টগ্রাম জন সংহতি সমিতি বিএনপির প্রার্থীদের, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী প্রসন্ন কান্তি তংচঙ্গ্যাকে সমর্থন ও পৌর সভা নির্বাচনে সতন্ত্র প্রার্থীকে সমর্থন করলে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী দিবে, নাকি অন্য প্রার্থীকে সমর্থন দিবে সেই ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়নি দলটি। তবে নির্বাচনে তাদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ্য অংশগ্রহন থাকবে। সেক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ বিরোধী যেকোন শক্তিকে দলটি সমর্থন দিতে পারে এমন মত রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের। এক সময়ের রাজনৈতিক মিত্র জনসংহতি সমিতির বিরোধিতার কারণে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়া আওয়ামী লীগের পক্ষে কঠিন হয়ে দাঁড়াবে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তবে ইতিমধ্যে জেএসএস সাথে আওয়ামী লীগের সম্পর্ক উন্নয়ন হচ্ছে, দুটি দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ বেড়েছে।
আওয়ামী লীগের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের ব্যাপারে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক জলি মং মার্মা পাহাড়বার্তাকে বলেন, রাজনীতিতে শেষ বলে কিছুই নেই, আওয়ামী লীগের সাথে আমাদের দূরত্ব কমেছে।

►জামায়েত,জাতীয় পার্টি ও ইউপিডিএফ :
বান্দরবানে জামায়াতের খুব একটা সমর্থক না থাকলেও বিগত নির্বাচনগুলোতে প্রার্থী দিয়ে বা অন্য প্রার্থীর পক্ষে সমর্থন দিয়ে আওয়ামী লীগবিরোধী একটি শক্ত প্রতিপক্ষ ছিল জামায়াতে ইসলামী। নিবন্ধন বাতিল হওয়ায় আগামী নির্বাচনে তারা দলীয় প্রার্থী নিয়ে মাঠে নামতে পারবে না। অন্যদিকে মামলায় জড়িয়ে জামায়াত নেতাদের অনেকেই এখন কোণঠাসা। অন্যদিকে জেলায় জাতীয় পার্টি ও ইউনাইটেড ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) এর রাজনীতি থাকলেও ইউপিডিএফ থেকে ছোটন কান্তি তংচঙ্গ্যাকে প্রার্থী হিসাবে ফের দেখা গেলেও জাতীয় পার্টি দলগতভাবে আওয়ামীলীগের প্রার্থীকে সমর্থন দিবে।

►শেষ কথা:
বান্দরবানে ১১টি পাহাড়ি জনগোষ্ঠীসহ বাঙালীদের বসবাস। সম্প্রীতির এই জেলায় সব হিসাবে কষে আসলে কে পাবেন দলীয় মনোনয়ন, আর প্রার্থী বা হচ্ছেন কারা আর ভোটারদের মন জয় করে আগামী সংসদ নির্বাচনে কে হাসবে জয়ের হাসি, তা দেখতে অপেক্ষা করতে হবে আরো কয়েক মাস।

আরও পড়ুন