বান্দরবান সদর হাসপাতালের অফিস সহায়ক যখন ডাক্তার !

NewsDetails_01

বান্দরবান সদর হাসপাতাল। ব্যস্ততম সময় । ইনডোর এবং আউটডোরে রোগীর ভীড়। ঋতু পরিবর্তন হওয়ায় হাসপাতালে কেউ আসছেন জ্বর, সর্দি, কাশি নিয়ে। আবার কেউ আসছেন অপারেশন করার জন্য। রোগীদের এমন অবস্থায় ছোটাছুটি করছেন নার্স, চিকিৎসক ও ওয়ার্ডবয়। কিন্তু সার্জারি কিংবা অপারেশন করতে গেলেই সবার আগে নাম শোনা যায় তোফাজ্জলের। কারো কাছে সে ডাক্তার আবার কারো কাছে সে ওয়ার্ড বয় হিসেবে পরিচিত। দীর্ঘ ১৮ বছর ধরে এই নামে চেনে সবাই। শুধু কি সরকারি হাসপাতাল, বেসরকারি ক্লিনিকগুলোতেও এক নামে পরিচিত তিনি। কিন্তু কমিশন নিয়ে সরকারি হাসপাতাল থেকে সদরের ক্লিনিকগুলোতে রোগী পাঠানোর ওস্তাদ বলা হয় তোফাজ্জলকে! শুধু রোগী পাঠানোয় নয় উনি করেন নিজেই সার্জারি আর অপারেশন। এমনও অনেক অভিযোগ তার বিরুদ্ধে।

বান্দরবান সদর হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা মো: সাইফুল ইসলাম নামে একজন ব্যবসায়ি জানান, আমার স্ত্রীর ডেলিভারি করার জন্য বান্দরবান সদর হাসপাতালে নিয়ে আসি। তখন মোফাজ্জল জানান রোগীর অবস্থা খারাপ। এখানে হবে না। ক্লিনিকে নিয়ে যেতে হবে। তারপরেই ক্লিনিকে নিয়ে গিয়ে ডেলিভারি করায়। সরকারিতে খরচ অনেক কম। তবে বেসরকারি হাসপাতালে এর খরচ অনেক বেশি। আমার মত গরিবদের বেসরকারিতে চিকিৎসা করানো সম্ভব না।

শুধু বেসরকারিতে রোগী পাঠানোয় নয়, সার্জারি কিংবা অপারেশন হলে প্রথমেই ডাক পড়ে তোফাজ্জলের। এমনও অভিযোগ আছে তাকে ছাড়া সরকারি হাসপাতালে কোন ধরনের অপারেশন হয় না। আর হাসপাতালে থাকা চিকিৎসক, নার্সদের কাউকেই তোফাজ্জল তোয়াক্কাও করেন না। বেসরকারিতে রোগী পাঠানো, সার্জারি এবং বিভিন্ন ধরনের অপারেশনে চলে তোফাজ্জলের বড় ধরনে কমিশন ও বাণিজ্য ।

বান্দরবান সদর হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা সাইমা আক্তার জানান, সদর হাসপাতালে অনেকবার চিকিৎসা নিয়েছি। কেঁটে গেলে কিংবা ভেঙ্গে গেলে তোফাজ্জল ভাইকে দেখতে পায় । উনিই আমাকে অনেকবার চিকিৎসা দিয়েছেন।

মাতৃমঙ্গলের সার্জারিয়ান তোফাজ্জল

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সদর হাসপাতালের কয়েকজন নার্স বলেন, মাতৃমঙ্গলে তোফাজ্জলকে চেনেন সার্জারিয়ান হিসেবে। রাত বিরাতে কোন নারীর ডেলিভারি অপারেশন করতে হলে তাকে ডাকেন চিকিৎসক,নার্সরা। তাকে ছাড়া মাতৃমঙ্গলে কোন ধরনের অপারেশন হয় না। সরকারি হাসপাতালে একই অবস্থা । আর বেসরকারি ক্লিনিকগুলোও তোফাজ্জল ছাড়া অচল।

তারা আরও জানান, রোগীর অবস্থা দেখে অনেক সময় তোফাজ্জল নিজেই তার চট্টগ্রামে থাকা প্রিয় এক ডাক্তারের কাছে অনেক রোগী পাঠিয়ে দেন।

বান্দরবান সদর হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা কবির হোসেন, আব্দুল রাজ্জাক সহ আরো কয়েকজন জানান, সরকারি হাসপাতাল হলো গরিব ও মধ্যবিত্তদের জন্য । এখানে উচ্চ বিত্তরা খুব কম আসে। বেশি টাকা দিয়ে ডাক্তারের কাছে চিকিৎসা করানো সম্ভব না। তার উপর সদর হাসপাতালে সেবা নিয়ে হয়েছে বড় ধরনের সিন্ডেকেট। ওয়ার্ডবয়, নার্স এবং চিকিৎসক মিলে মিশে হয়েছে বড় ধরনের সিন্ডিকেট ।

NewsDetails_03

তারা আরো বলেন, সেবার ক্ষেত্রে চিকিৎসক, নার্সদের সিন্ডিকেট থাকা উচিত নয়। আর সিন্ডিকেট থাকলে ভেঙে পড়বে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। ভুগবে জনগণ, অপচয় হবে রাষ্ট্রের । তাই তোফাজ্জলদের মতো আর কেউ যেন এ হাসপাতালে না থাকে সেই আশাটায় করি ।

পরিদর্শনে বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, তোফাজ্জলকে দেখল অপারেশন কেন্দ্রে:

১৯ অক্টোবর সকাল সাড়ে ১১টার দিকে হঠাৎ বান্দরবান সদর হাসপাতালে যান বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ক্য শৈ হ্লা। এ সময় তিনি হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডে গিয়ে স্বাস্থ্য সেবা নিয়ে রোগীদের কাছে জানতে চান। পরিদর্শনের এক ফাঁকে তিনি ঢুকেন অপারেশন থিয়েটারে। এসময় দেখতে পান তোফাজ্জল ডেলিভারি রোগীর অপারেশন করছেন । পরে জানতে চান তোফাজ্জলের পরিচয় । তখন তোফাজ্জল নিজেকে ওটি বয় হিসেবে পরিচয় দেন।

এছাড়াও তোফাজ্জল বলেন, হাসপাতালের চেয়ার টেবিল সরানোর কাজ করি।

তোফাজ্জলের চিকিৎসকের বেশ ভূষা দেখে বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ক্য শৈ হ্লা বলেন, তোফাজ্জলের বিষয়ে অনেক রোগী অভিযোগ দিয়েছে। আজ স্ব চক্ষে দেখলাম। আমি তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সিভিল সার্জনকে নির্দেশ দিয়েছি। অফিস সহায়ক দিয়ে সরকারি হাসপাতালে কারো ডেলিভারি রোগী অপারেশন করা কাম্য নয় ।

অফিস সহায়ক নাকি ওয়ার্ড বয় জানেন না সিভিল সার্জন :

হাসপাতাল পরিদর্শন শেষে বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ক্য শৈ হ্লা কর্তব্যরত চিকিৎসক, নার্সদের সাথে মতবিনিময় করেন। এসময় তোফাজ্জল কোন পদে কাজ করেন জানতে চাইলে বান্দরবানের সিভিল সার্জন ডা: নীহার রঞ্জন চৌধুরী জানান, তোফাজ্জল ওয়ার্ড বয় হিসেবে হাসপাতালে কাজ করেন। আমি ওয়ার্ড বয় হিসেবে জানি।

কিন্তু অনুসন্ধানে দেখা যায়, পুরো নাম মো: তোফাজল হোসেন । তার বাবা মো: আবুল কালাম। ১৯৮৪ সালের ১০ এপ্রিল তার জন্ম । ২০০৪ সালের ২১ শে অক্টোবর বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের ন্যস্ত স্বাস্থ্য বিভাগের ১৯ তম গ্রেডের অফিস সহায়ক পদে যোগদান করেন।

এছাড়াও রোগীর স্বজন, নার্স এবং চিকিৎসকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, বান্দরবান সদর হাসপাতালে অনেক রোগী তোফাজ্জলকে ডাক্তার হিসেব ডাকেন। আবার অনেক নার্স ও চিকিৎসকদের কাছে সে ওটি বয় কিংবা ওয়ার্ড বয়। আসলে তার পরিচয় অফিস সহায়ক।

আরও পড়ুন