পাহাড়ের বাঁশিওয়ালা ধারশ মনি চাকমা

NewsDetails_01

বাঁশি হলো এক ধরনের সুষির অর্থাৎ ফুৎকার দিয়ে বাজানো যায় এমন বাদ্যযন্ত্র। বাংলায় বাঁশিকে মুরালি, মোহন বাঁশি, বংশী অথবা বাঁশরিও বলা হয়। বাঁশির পাশ্চাত্য সংস্করণের নাম ফ্লুট। যে যেই নামে ডাকুক না কেন বাঁশির সুরে বিমোহিত হন না এমন কোন লোক পাওয়া যায় না। তেমনিই পাহাড়ের সুর জাগানিয়া একজন বংশী বাদক এবং কন্ঠ শিল্পী ধারশ মনি চাকমা।

রাঙামাটির সঙ্গীতাঙ্গনের একটি পরিচিত মুখ ধারশ মনি চাকমা। ১৯৭৭ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি কাউখালি উপজেলার ঘাগড়া ইউনিয়নে মহাজন পাড়া গ্রামে পিতা প্রয়াত কালন জয় চাকমা এবং মাতা প্রয়াত সত্য বানু চাকমার গর্ভে জন্মে নেওয়া এই শিল্পী বাংলাদেশ বেতার রাঙামাটি আঞ্চলিক শাখার একজন তালিকাভুক্ত বংশীবাদক। পাহাড়ের বিভিন্ন উৎসব পার্বনে কিংবা ধর্মীয় কোন অনুষ্ঠানে তাঁর বাশিঁর সুরে বিমোহিত হন নাই এমন কোন দর্শক নাই।

শিল্পী ধারশ মনি চাকমা একজন প্রকৃত সংস্কৃতিনুরাগী। পাহাড়ের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সংস্কৃতির আলো ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য তিনি স্ব উদ্যোগে গিয়ে বাঁশি বাজানোর পাশাপাশি গানও শেখান ছাত্র ছাত্রীদের। কখনো হয়তো তিনি পারিশ্রমিক পেয়েছেন হয়তো বা পাননি। কিন্তু এরপরেও তিনি এক মূহুর্তের জন্য সুর সাধনা হতে পিছপা হন নাই।

শিল্পী ধারশ মনি চাকমা ২০০৭ সালে ঘাগড়া কালচারাল একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি সে সকল প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করেছেন, নাটক মঞ্চায়ন করেছেন, শিশু-কিশোরদের সংগীত বিষয়ে তালিম দিয়েছেন যেখানে হয়তো বিজুর গানের সুর তখনো পৌঁছায়নি। তার পূর্ণিমা নামে একটি ধর্মীয় অ্যালবাম প্রকাশ পায়। যাতে তাঁর বেশ কয়েকটি মৌলিক গান ছিল। তাঁর এই শিল্পকর্মে অবদানের জন্য ২০১৫ সালে জেলা শিল্পকলা একাডেমি, রাঙামাটি তাঁকে একজন শিল্পী হিসেবে সম্মাননা প্রদান করেন। পার্বত্য মন্ত্রী বীর বাহাদুর প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে তাঁর নিকট সম্মাননা তুলে দেন।

NewsDetails_03

চলতি বছরের গত ২৫ ডিসেম্বর জেলা শিল্পকলা একাডেমি, রাঙামাটির আয়োজনে শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে গণজাগরণের যন্ত্র সঙ্গীত উৎসব ২০২৩ অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে তিনি একক এবং সমবেত যন্ত্র সঙ্গীতে বাঁশির সুর পরিবেশন করে দর্শক শ্রোতার অকুন্ঠ প্রশংসা অর্জন করেন। সেই দিন তাঁর সাথে এই প্রতিবেদকের কথা হয়।

তিনি বলেন, আমি দীপায়ন চাকমা ও বীর কুমার চাকমার নিকট বংশীবাদনের উপর তালিম নিই। রাঙামাটির গুনী শিল্পী রনজিত দেওয়ানের প্রেরনায় আমি সংগীত সাধনা এবং বাঁশি সাধনা শুরু করি।
কখনো অর্থের মোহে আমি সুর সাধনা কিংবা সঙ্গীত পরিবেশন করি নাই। পেশা নয় নেশা হিসাবে আমি সুর সাধনা করে যাচ্ছি। বাঁশি এবং গান আমার হৃদয়ের সাথে মিশে আছে। আমৃত্যু আমি এই সাধনা চালিয়ে যেতে চাই।

রাঙামাটি জেলা শিল্পকলা একাডেমির কালচারাল অফিসার অনুসিনথিয়া চাকমা বলেন, ধারশ মনি চাকমা একজন নিভৃতচারী শিল্পী। আজ আমাদের মাঝে বাঁশি সহ দেশীয় অনেক যন্ত্র হারিয়ে যাচ্ছে। পাশ্চাত্য সঙ্গীতের আগ্রাসনে আমরা হারাতে বসেছি নিজস্থ সংস্কৃতি। কিন্তু ধারশ মনি চাকমা এখনো বাঁশির সুর চর্চা করে যাচ্ছেন। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির সুযোগ্য মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকি স্যার দেশব্যাপী যেই গণজাগরণের যন্ত্র সঙ্গীত উৎসবের আয়োজন করেছেন, তারই অংশ হিসাবে ২৫ ডিসেম্বর জেলা শিল্পকলা একাডেমি, রাঙামাটিতে এই যন্ত্র সঙ্গীত উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। এদিন ধারশ মনি চাকমার একক বাঁশি বাদন আমাদেরকে মুগ্ধ করেছে।

রাঙামাটি জেলা শিল্পকলা একাডেমির সঙ্গীত প্রশিক্ষক বেতার ও টিভি শিল্পী মিলন ধর বলেন, ধারশ মনি চাকমার মতো ক্ষণজন্মা শিল্পী আসে বলে এখনো আমাদের নিজস্থ সংস্কৃতি ঠিকে আছে।

প্রসঙ্গত: শিল্পী ধারশ মনি চাকমা ১৯৯১ সালে রাঙামাটি মোনঘর আবাসিক উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এস,এস সি ও ১৯৯৩ সালে রাঙামাটি সরকারি কলেজ থেকে এইচ,এস,সি পাস করেন। ১৯৯৮ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিত বিষয়ে বি,এস,সি ( অনার্স) পাস করেন। বর্তমানে তিনি কাউখালি উপজেলার বর্মাছড়ি বাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক এর দায়িত্ব পালন করছেন। ব্যক্তি জীবনে তিনি এক পুত্র ও এক কন্যা সন্তানের জনক,তার স্ত্রীর নাম ইখা চাকমা।

আরও পড়ুন