বান্দরবানে খেয়াং সম্প্রদায়ের বর্ণমালার কী-বোর্ড উদ্বোধন

NewsDetails_01

বান্দরবান পার্বত্য জেলায় এবার খেয়াং সম্প্রদায়ের মাতৃভাষায় উদ্ভাবিত “হোয়ো” বর্ণমালায় কম্পিউটার কী-বোর্ড উদ্বোধন করা হয়েছে। আজ শনিবার (৩ সেপ্টেম্বর) বেলা ১টায় সদর উপজেলার কুহালং ইউনিয়নের গুংগুরুমুখ খেয়াং কমিউনিটি সেন্টারে এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে হোয়ো বর্ণমালায় কম্পিউটার কী-বোর্ড উদ্বোধন হয়।

এসময় অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, যাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে এই ভাষাটি কম্পিউটার কী-বোর্ডে যুক্ত করার উপযোগী করা হয়েছে, তাদেরকে এই জনগোষ্ঠীর লোকেরা স্বরণ করবে। ফ্রেন্ডস অব এন্ডেঞ্জার্ড এথনিক ল্যাংগুয়েজস (ফিল) সংস্থার তত্বাবধানে প্রায় ২ মাসের প্রচেষ্টায় এই ভাষার বর্ণমালা কম্পিউটার কী-বোর্ডে যুক্ত করতে সক্ষম হন। ভবিষ্যতে মোবাইল কী-বোর্ডে ব্যবহারের উপযোগী এ্যাপস তৈরি করা হবে। যার ফলে পাহাড়ী অন্য সম্প্রদায়ের মতো মোবাইলেও খেয়াং ভাষার বর্ণ মালা ব্যবহার করে তথ্য আদান প্রদান করতে পারবেন খেয়াং ’রা।

ফ্রেন্ডস অব এন্ডেঞ্জার্ড এথনিক ল্যাংগুয়েজস (ফিল) Frends of endangered ethnic Languages (FEEL)) সংস্থার ভাষা গবেষক রিবেং দেওয়ান বলেন, দেশে বিপন্ন প্রায় যে ভাষাগুলো রয়েছে সে ভাষাগুলোকে ডিজিটালাইজ করার লক্ষ্য নিয়ে দুই বছর আগে যাত্রা শুরু করে সংস্থাটি। এই পর্যন্ত ১৬ টি বিপন্ন ভাষায় কম্পিউটার কী-বোর্ড তৈরিতে সক্ষম হয়েছেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, এর মধ্যে ভাষা গবেষক মৃদুল সাংমা, ভাষা প্র‍যুক্তিবিদ সমর এম সরেনসহ ৭ জন সদস্যের প্রচেষ্টায় খেয়াং ভাষায় উদ্ভাবিত কী-বোর্ডটি দেশে এবং এশিয়া মহাদেশে নবীনতম ডিজিটালাইজ ভাষায় যুক্ত হল। যা পৃথিবীর লিখিত ডিজিটালাইজ ভাষার মধ্যে ২৯৪ তম কী-বোর্ড
ভাষায় স্থান পেয়েছে। এই ভাষার প্রচলন ও চর্চা বাড়াতে খেয়াং ভাষায় কবিতা, উপন্যাস, রুপকথার গল্প উদ্ভাবিত বর্ণমালায় লেখার আহবান জানান। এছাড়াও খেয়াং, পাহাড়িয়া কুড়ুখ, চাকমা, ম্রো, আবেং (গারো), মেগাম (গারো), কোল, মুন্ডা, সান্তাল, খুমী ও খাড়িয়া, সওরা সম্প্রদায়ের ভাষা রিসোর্স ও
রাইটিং টুলস, ভাষা অভিধানের প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।

NewsDetails_03

খেয়াং ভাষা বর্ণ মালার উদ্ভাবনের অন্যতম সদস্য ঞো জাই উ খেয়াং বলেন, ২০১৭ সালে ২২শে অক্টোবর খেয়াং ভাষা ও বর্ণমালা বইয়ের প্রকাশনা উৎসব হয়। খেয়াং ভাষার বর্ণমালার মধ্যে স্বর বর্ণ ১১টি, ব্যঞ্জন বর্ণ ২১ টি। উদ্ভাবিত খেয়াং ভাষার সাথে উচ্চারন, ধ্বনি সবকিছুই ঠিক আছে এবং শেখা খুবই সহজ। এলাকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে খেয়াং ভাষা শেখানো হয়েছিল, আর্থিক সংকটের কারনে তা বন্ধ হয়ে যায়।

তিনি আরো বলেন, রোমান হরফে বর্ণমালায় খেয়াং ভাষার উচ্চারন ও ধ্বনির কিছুই মিল নেই, রোমান হরফ দিয়ে লেখা ও ভাষা চর্চা করা হলে খেয়াং জনগোষ্ঠীর নিজস্ব ঐতিহ্য, সংস্কৃতি মূল্যবোধ সব হারিয়ে যাওয়ার আশংকা ছিল বলে জানান তিনি।

আরো জানা গেছে, প্রথম খেয়াং বর্ণমালার উদ্ভাবক ক্যসামং খেয়াং, এই বর্ণমালা নিয়ে ১৯৯৯ সাল থেকে কাজ শুরু করেন। ২০০৪ সালে খেয়াং বর্ণমালা পূর্ণাঙ্গ রূপ দেওয়া সম্ভব হয়। ইউএনডিপির মাধ্যমে ২০০৬ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে ভাষা নিয়ে কাজ করতে আসা ইংল্যান্ডের নাগরিক জন ক্রিপ্ট নামে একজন ভাষা ও বর্ণমালা বিশেষজ্ঞ তার তৈরি বর্ণমালা তৈরির কাজ তত্ত্বাবধান করেছিলেন। এরপর গুংগুরু খিয়াংপাড়ার ৫ জন বাসিন্দার নেতৃত্বে আরেকটি খেয়াং বর্ণমালা তৈরি করা হয় ২০১৭ সালে। বর্ণমালা তৈরি এই দলে ছিলেন স্কুল শিক্ষক, উন্নয়নকর্মী, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসহ মোট ৫জন। তাদের তৈরি বর্ণমালার মধ্যে রয়েছে ২৩ ব্যঞ্জনবর্ণ ও ১১টি স্বরবর্ণ। আগের তৈরি বর্ণমালা কিছুটা পরিবর্তন করে আরেক দফা বর্ণমালা তৈরি করা দলের একজন ঞোজাইউ খেয়াং। বর্তমানে তিনি জেলার খেয়াং ভাষা ও বর্ণমালা কমিটির সভাপতি।

সমাজ কর্মী অংসাউ খেয়াং এর সভাপতিত্বে অনুষ্টানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের সাবেক সদস্য ম্রাসা খেয়াং। অন্যান্যদের মধ্যে ভাষা গবেষক মৃদুল সাংমা, ভাষা প্রযুক্তিবিদ সমর এম সরেন, গবেষক রিবেং দেওয়ান, শিক্ষিকা হ্লা ক্রই প্রু খেয়াং, চিংহ্লা উ
খেয়াং, সাংবাদিক বুদ্ধজ্যােতি চাকমা প্রমূখ।

প্রসঙ্গত, ২০১৪ সালে বাংলাদেশের নৃভাষা বৈজ্ঞানিক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ১৫টি ভাষা বিপন্ন ভাষার তালিকায় রয়েছে। তার মধ্যে তিন পার্বত্য জেলার ৫টি বিপন্ন ভাষার মধ্যে খেয়াং ভাষা রয়েছে।

আরও পড়ুন