রেশম চাষে ফের স্বপ্ন দেখছে লামার শত শত নারী

NewsDetails_01

সেই আশির দশকের কথা। যে সময়টায় বান্দরবান জেলার লামা ও আলীকদম উপজেলার অধিবাসীদের ছিল না তেমন কোন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা। এমন সময় বাংলাদেশ রেশম বোর্ডের সহযোগিতায় প্রতি ঘরে ঘরে শুতা উৎপাদনকারী পলু পোকা পালন করতে শুরু করে অদিবাসীরা। আর এ চাষের আয় থেকে সংসার চলত দুই উপজেলার শত শত পরিবারের। বেশ কয়েক বছর চলার পর তৎকালীন সরকারের স্বদিচ্ছার অভাবে এ চাষে সংকট দেখা দেয়। এতে মাঝ পথে অন্য চাষে ঝুঁকে পড়ে চাষীরা। ২০১৯ সালে বাংলাদেশ রেশম উন্নয়ন বোর্ডের ‘রেশম চাষ সম্প্রসারণ ও উন্নয়নের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন’ শীর্ষক প্রকল্পের উদ্বুদ্ধকরণে সেই রেশম আবার স্বপ্ন দেখাচ্ছে সুদিন ফেরানোর। সরকারিভাবে প্রশিক্ষণ নিয়ে গ্রামের শত শত নারী এখন রেশম চাষে ঝুঁকছেন। তুত গাছ রোপণ করে রেশম পোকার খাবারের জোগানও দিচ্ছেন চাষীরা। একজনের দেখাদেখি অন্য নারীরাও এগিয়ে আসছেন রেশম চাষে। নিজেদের স্বাবলম্বী করা সহ দেশের এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখার পাশপাশি হারিয়ে যাওয়া সেই কৃষি শিল্পের ঐতিহ্য বহনকারী রেশম চাষে উদ্যোগী হয়ে এখন স্বপ্ন দেখছেন দুই উপজেলার শতশত নারী।

রেশম বোর্ড সূত্রে জানা যায়, ২০১৯ সালে ‘রেশম চাষ সম্প্রসারণ ও উন্নয়নের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন প্রকল্পের’ আওতায় লামা ও আলীকদম উপজেলার প্রায় ৮শত ৮৮জন চাষী বাছাই করা হয়। এসব উপকারভোগী চাষীকে প্রশিক্ষণের পাশাপাশি বিনামূল্যে তুঁত চারা। প্রতিজন চাষীকে ২০০টি করে চারা দেওয়া হয়। এ হিসেবে লামা উপজেলায় ১ লক্ষ ১৫ হাজার ৮০০টি ও পাশের আলীকদম উপজেলায় দেওয়া হয় ৪৯ হাজার তুঁত চারা। এ তুঁত গাছের পাতা আবার পলু পোকার খাবার। এ পাতা খেয়েই পোকা বড় হয়ে রেশম গুটি তৈরি করে। এ গুটি থেকে উৎপাদন হয় রেশম সূতা। এর মধ্যে দুই উপজেলায় ১৭১ জন বসনী পলু চাষি রয়েছে। সময়ে এ বসনীর সংখ্যা বাড়ে ও কমে থাকে। বসনীদেরকে বিনামূল্যে ডিম, ডালা, চন্দ্রকি, সূতার জাল, ঘড়া, ব্লিচিং পাউডার ও চুন দেওয়া হয়। শুধু তায় নয়, এ চাষীদেরকে সহায়তা বাবদ প্রতিজন বসনীকে প্রথম কিস্তিতে ২০ হাজার ও দ্বিতীয় কিস্তিতে ২০ হাজার টাকা হারে মোট ১৫০ জনকে ৪০ হাজার টাকা করে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে দেওয়া হয়। এ হিসেবে ১৫০ জন বসণী পলু চাষি পলু ঘর নির্মাণের জন্য সাড়ে চার বছরে পায় ৬০ লাখ টাকা।

লামা উপজেলার রুপসীপাড়া ইউনিয়নের মুরুংঝিরির বসনী স্বপ্না বেগম জানান, তার স্বামী মাঠে কৃষি কাজ করেন। স্বামীর সামান্য রোজগারে ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়াসহ নানা খরচ জোগানে সমস্যা তৈরি হতো তাদের পরিবারে। তিনি ২০১৯ সালে রেশম বোর্ডের উদ্বুদ্ধকরণে পলু চাষ শুরু করেন। আর এতে যেন পাল্টে যায় তাদের সংসারের চিত্র। প্রতি বছর স্বপ্না বেগম নিজেই আয় করছেন প্রায় লাখ টাকা। এতে ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়াসহ সংসারে সচ্ছলতা ফিরে আসে।

একই কথা জানালেন পাশের মোহসেনা বেগম। নয়াপাড়ার বসনী চাষী হাসিনা বেগম ও ছলেমা এক সূত্রে জানায়, এ চাষ শুরুর আগে অভাবের সংসার ছিল তাদের। অভাব মোচনে তারা রেশম চাষ শুরু করেন। স্বামীরা মাঠে কাজ করেন আর স্ত্রীরা বাড়িতে রেশম চাষ ও গবাদি পশু পালন করেন। এতে কয়েক বছরেই তাদের সংসারে সচ্ছলতা ফিরেছে। এ চাষ অব্যাহত রাখতে সরকারের প্রতি জোর দাবী জানান চাষীরা।

NewsDetails_03

সরেজমিন পলু ঘর পরিদর্শনে গেলে চাষীরা জানায়, একটি ঘরের ৫ ফুট স্কয়ার ডালায় পলুর ডিম রাখতে হয়। সেখানে তুঁতের পাতা দিলেই পলুগুলো খেয়ে খেয়ে ২৫ থেকে ৩০ দিনের মধ্যে রেশম গুটিতে পরিণত হয়। এ গুটি বছরে চারবার উৎপাদন হয়। প্রতি ১০০ পলু পালনে প্রায় ৪০ হাজার টাকা লাভ হয়। এ হিসেবে বছরে প্রায় ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা লাভ হয়। তাছাড়া চাষিরা তুঁত গাছ চাষ করলে জীবিত হারে গাছপ্রতি প্রথম বছর আট টাকা, দ্বিতীয় বছর চার টাকা ও তৃতীয় বছর চার টাকা পান। পলু ঘর বাবদ দুই কিস্তিতে ৪০ হাজার টাকা পেয়েছেন বলেও জানান বসনীরা। এছাড়া বিভিন্ন ইউনিয়ন ঘুরে দেখা গেছে- রাস্তার পাশে, পাহাড়ের পাদদেশে ও বাড়ির আঙ্গিনায়. জমির আইলে সারিবদ্ধভাবে তুঁত গাছ রোপণ করা হয়েছে। এসব তুত গাছ থেকেই রেশম পোকার খাবার সংগ্রহ করা হয়। পাশাপাশি এসব তুত গাছ সবুজের সৌন্দর্য বাড়িয়েছে এলাকার।

জানা যায়, প্রতিটি বাড়িতে রেশম পোকা বিতরণ থেকে গুটি তৈরি পর্যন্ত সবকিছু তদারক করছে রেশম বোর্ড। পরে উৎপাদিত গুটি কৃষকের কাছ থেকে কাহন দরে কিনে নেয় রেশম বোর্ড। আর এ থেকে সুতা উৎপাদন করা হয়। বছরে চারবার রেশমগুটি উৎপাদন করা যায়। প্রতি বছর ভাদ্র, অগ্রহায়ণ, চৈত্র ও জ্যৈষ্ঠ মাসে রেশমগুটি সংগ্রহ করা হয়। কৃষককে রেশম পোকার ডিম প্রদানের পর কয়েক দিনেই জন্ম নেয় পোকা। পরে তুত গাছের পাতা কেটে কুচি কুচি করে পোকার খাবার সরবরাহ করা হয়। এভাবে আবহাওয়ার উপর নির্ভর করে ২২-২৫ দিনের মধ্যেই তৈরি হয়ে যায় গুটি। আর এখান থেকে তৈরি হয় রেশম সুতা। রেশম চাষে বছরে কমপক্ষে ৪ থেকে ৫ বার ফসল ফলানো যায় এবং অধিক অর্থ উপার্জন করা যায়।

জানতে চাইলে লামা রেশম সম্প্রসারণ কেন্দ্রের ম্যানেজার ও টেকনিক্যাল অফিসার মো. ফেরদৌসুর রহমান জানান, লামা রেশম সম্প্রসারণ কেন্দ্রের অধীনে রেশম চাষ হচ্ছে। রেশম চাষে নারীদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ করে এ চাষে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। লামা ও আলীকদম উপজেলার ১৫০ জন বসনী বাড়িতে পলু ঘর নির্মাণসহ যাবতীয় আনুষাঙ্গিক কাজে সহায়তা করা হয়েছে। তিনি আরও জানান, দেশে মোট ১২টি রেশম সুতার কারখানা আছে, তার মধ্যে বান্দরবান জেলার লামা উপজেলার রেশম বোর্ডে একটি সুতা কারখানা আছে। এটি তুঁত চাষিদের জন্য আশার আলো। তিন পার্বত্য জেলায় উৎপাদিত রেশম গুটি ক্রয় করে লামা মিনিফিলেচার কেন্দ্রে রেশম সূতা উৎপাদন করা হয়।

এ বিষয়ে রাঙামাটি রেশম সম্প্রসারণ কেন্দ্রের প্রকল্প পরিচালক ড. মো সিরাজুর রহমান বলেন, ১৯৮০ সালে লামা উপজেলায় রেশম সম্প্রসারণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। মাঝখানে এ চাষ বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমান সরকার গ্রামীন নারীদের স্বাবলম্বী করতেই মূলত রেশম চাষ সম্প্রসারণে উদ্যোগ নেয়। ২০১৯ সাল থেকে নতুন করে ‘বাংলাদেশ রেশম চাষ সম্প্রসারণ ও উন্নয়নের মাধ্যমে দারিদ্র বিমোচন’ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। এখন নতুন নতুন পরিবার এ চাষে যুক্ত হচ্ছে। সরকারি এ উদ্যোগে তুঁত গাছ, রেশম গুটি ও সুতা সংগ্রহ পুরো প্রক্রিয়ায় যুক্ত থাকে রেশম বোর্ড। রেশম চাষি নারীদের নির্বিঘ্নে চাষ ও বাজারজাতের কারণে কয়েক মাস পরেই তারা ভালো টাকা আয় করতে পারেন। রেশম তুঁত চাষ করে অনেক পরিবারের মুখেই স্বচ্ছলতার হাসি এনে দিয়েছে বলেও মন্তব্য এ কর্মকর্তা।

আরও পড়ুন