শান্তি চুক্তির দুই যুগ পূর্তি : বেড়েছে উন্নয়ন, কমেনি সংঘাত

NewsDetails_01

১৯৯৭ থেকে ২০২১। শান্তি চুক্তির দুই যুগ পুর্তি। প্রতি বর্ষপুতির মত দিবসটি উপলক্ষে ২রা ডিসেম্বর রাঙামাটি রিজিয়ন ও পার্বত্য জেলা পরিষদ করোনাকালে স্বাস্থ্যবিধি মেনে দিনব্যাপী ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। গত দুই যুগ ধরে পাহাড়ে ব্যাপক উন্নয়ন হলেও, কমেনি সংঘাত। সংঘাতের ধারাবাহিকতায় দুইযুগ পুর্তির মাত্র ৪৮ ঘন্টা আগে আঞ্চলিক স্বশস্ত্র সংগঠনের দ্বন্ধে রাঙামাটি শহরের বন্দুকভাঙ্গা এলাকায় খুন হতে হলো জেএসএসের এক নেতাকে।

শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর থেকে পাহাড়ে শান্তির সুবাতাস বইতে শুরু করে। চুক্তির ফলে স্বাভাবিকতা ফিরে আসে পাহাড়ে। যোগাযোগ ব্যবস্থা থেকে শুরু করে বেড়েছে পর্যটকদের আনাগোনা। স্বচ্ছলতায় ফিরেছে অর্থনৈতিক চাকা। চুক্তির আগে সবই ছিল কল্পনাতীত এবং আতঙ্কের। চুক্তির ফলে গত দুই যুগে পাহাড়ের আনাচে-কানাচে উন্নয়নের চাকা ঘুরেছে বিরামহীন গতিতে। পর্যটন শহর হিসেবে ব্যাপক সুনামে বিস্তৃতি ছড়িয়েছে সর্বত্র। পাহাড়ের বুক চিড়ে মাইলের পর মাইল চোখ ধাঁধানো আকাঁবাঁকা-উচনিচু রাস্তা তৈরি হয়েছে। ঝুলন্ত ব্রীজ থেকে শুরু করে সুদর সাজেক পর্যটন স্পট আজ সর্বত্র সুনাম ছড়িয়েছে। গড়ে উঠেছে নতুন পর্যটন স্পট থেকে শুরু করে বড় বড় হোটেল-রেস্তোরাঁ। প্রতিনিয়ত আসছে শত শত পর্যটক। পাহাড়ের ব্যাপক উন্নয়ন হওয়ার ফলে পাহাড়ে শান্তির পাশাপাশি বসবাসকারীদের আর্থ-সামাজিক জীবনেও এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন।

তথ্যমতে, শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে বিগত ২৪ বছরে বেশ কিছু পদক্ষেপ গৃহীত হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং আঞ্চলিক পরিষদ গঠন করা হয়েছে। তিনটি পার্বত্য জেলা পরিষদ এবং নিয়ন্ত্রণাধীন ৩৩টি দফতর-সংস্থার মধ্যে রাঙামাটিতে ৩০টি হস্তান্তর করা হয়েছে। ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি করতে গঠন করা হয়েছে ভূমি কমিশন। প্রত্যাগত ১২ হাজার ২২৩টি উপজাতি শরণার্থী পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। সংসদ উপনেতার নেতৃত্বে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন মনিটরিং কমিটি গঠন করা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটি গঠন করা হয়েছে। নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান বিল-২০১০ জাতীয় সংসদে গৃহীত হয়েছে। তিন পার্বত্য জেলায় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। উন্নয়নের মধ্যে সীমান্তে ১ হাজার কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। রাঙামাটির নানিয়ারচরে চেঙ্গি নদীর ওপর ৫০০ মিটার দীর্ঘ সেতু নির্মাণ করায় এ এলাকায় যোগাযোগের চিত্র সম্পূর্ণ পালটে গেছে। এখন কৃষিপণ্য দ্রুত এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নেওয়া যাচ্ছে। এতে পণ্যের ন্যায্যমূল পাচ্ছেন কৃষকরা। পাহাড়ের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিদ্যুৎ পৌঁছে যাচ্ছে। যেখানে বিদ্যুৎ যাওয়ার সম্ভাবনা নেই, সেখানে সৌর বিদ্যুতের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। কৃষকরা ন্যায্য ও বিনামুল্যে সার বীজ পাচ্ছে। পাহাড়ে পাহাড়ে সবুজ ফসলের বিপ্লব চলছে।

তবে উল্টোচিত্রে কমেনি সংঘাত। পাঁচটি আঞ্চলিক সংগঠন নিজেদের মধ্যে হানাহানি অব্যাহত রেখেছে। তাদের মধ্যে চাঁদাবাজির ভাগাভাগি নিয়ে চলছে সংঘাত ও প্রাণহানির ঘটনা। চার সন্ত্রাসী গ্রুপের অত্যাচারে পার্বত্যাঞ্চলে অতিষ্ঠ পাহাড়ি-বাঙালি। একটি হিসাবমতে, শান্তিচুক্তি পরবর্তী দুইযুগে আঞ্চলিক সংগঠনের দ্বন্ধে প্রাণ হারাতে হয়েছে প্রায় ৫ হাজার নেতাকর্মীকে। এই সংখ্যায় বলি পাঁঠা হয়ে মরতে হয়েছে বহু আওয়ামী লীগ পাহাড়ী নেতাকর্মীকে। হিসাবমতে, আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর বছরে চাঁদার আদায়ের পরিমান প্রায় ৪শত কোটি টাকা। ঠিকাদারী থেকে শুরু করে চাকরীজীবি, পেশাজীবি, কৃষক, জেলে, খামারী সবার থেকে নির্দিষ্ট হারে চাঁদা আদায়ে ব্যস্ত তারা। চাঁদাবাজি ও স্বশস্ত্র হামলার অভিযোগে প্রায়শঃ যৌথবাহিনীর অভিযানে ব্যাপকহারে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করা হয়।

NewsDetails_03

রাঙাামাটির জেলা প্রশাসক মিজানুর রহমান বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার পাবর্ত্যাঞ্চলের ব্যাপক উন্নয়ন করেছে। পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে সবার সদিচ্ছার প্রয়োজন।

রাঙামাটি জেলার পুলিশ সুপার মীর মোদদাছছের হোসেন বলেন, পাহাড়ের সহজ সরল মানুষ শান্তি চায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পাহাড়ে যে ব্যাপক উন্নয়ন করেছেন, তাতেই কৃতজ্ঞ পাহাড়ি-বাঙালিরা। সামান্য কিছু মানুষ অশান্তি চায়। তবে, পাহাড়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির স্বাভাবিক রয়েছে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান নিখিল কুমার চাকমা বলেন, শান্তিচুক্তির পর পার্বত্যাঞ্চলে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। যেখানে যা প্রয়োজন তা চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। আঞ্চলিক দলসমূহ নিজেদের আধিপত্য নিয়ে সংঘাত সমস্যায় ব্যস্ত। তিনি বলেন, শান্তি চুক্তি সকলের জন্য, এটি বাস্তবায়নে সকলেরই আন্তরিক সহযোিগতা প্রয়োজন রয়েছে।
রাঙামাটি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অং সুই প্রু চৌধুরী বলেন, শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে সকলের সদিচ্ছা প্রয়োজন। সমস্যা ও সংকট থাকবে, চুক্তি বাস্তবায়নে সবাইকে আন্তরিক হতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর দুঃসাহসিক পদক্ষেপে শান্তিচুক্তির পর পাহাড়িদের জীবনমান উন্নয়ন অনেক হয়েছে। ছেলেমেয়েরা সুশিক্ষিত হচ্ছে। সরকারি উচ্চ পর্যায়ে চাকরিও পাচ্ছে। কিন্তু শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে আঞ্চলিক দলগুলোর সহযোগিতার ঘাটতি রয়েছে।

তবে, শান্তিচুক্তির দুইযুগ পুর্তিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির কেউই বক্তব্য দিতে অপরাগতা প্রকাশ করলেও দলটির দায়িত্বশীল সুত্র থেকে জানা গেছে, ভূমি কমিশন বিধিমালা প্রণয়ন, সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার, পার্বত্য চট্টগ্রামের এক হাজার ৯০০ শাসন বিধি কার্যকর রাখা, স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে ভোটার তালিকা প্রণয়ন করে পার্বত্য জেলা পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদ নির্বাচনসহ সাত দফা দাবিতে অনড় রয়েছে দলের নেতৃবৃন্দরা।

প্রসঙ্গতঃ পাহাড়ে রক্তাক্ত পরিস্থিতির অবসানে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর জেএসএসের সঙ্গে শান্তিচুক্তি করে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও মন্ত্রিসভার সদস্যদের উপস্থিতিতে সরকারের পক্ষে চিফ হুইপ আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ এবং জেএসএসের পক্ষে সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) চুক্তিতে সই করেন।

আরও পড়ুন