আওয়ামী লীগের একক প্রার্থী বীর বাহাদুর : বিএনপি’র চেষ্টা আসন দখল

বান্দরবান ৩০০ নং আসন

পার্বত্য জেলায় আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসাবে পরিচিত বান্দরবান ৩০০ নং আসন ধরে রাখতে মরিয়া আওয়ামী লীগ, অন্যদিকে নিজেদের কোন্দল মিটিয়ে আসন দখল নিতে তৎপর বিএনপি। বান্দরবান ৩০০ নং আসনে আওয়ামী লীগ থেকে টানা ৬ বার নির্বাচিত বীর বাহাদুর উশৈসিং এমপি’র দলীয় মনোনয়ন নিশ্চিত ভাবে ধরে নেওয়া গেলেও বিএনপির মনোনয়ন কে পাচ্ছেন, আর কোন দল কাকে সমর্থন দিচ্ছেন তা নিয়ে নেতাকর্মীদের বিশ্লেষনের যেন শেষ নেই। অন্যদিকে জেলার রাজনীতির মাঠের গুঞ্জন আর সমিকরণ নিয়ে এখন থেকেই কখনও সরব, কখনও নিরবে নির্বাচন কেন্দ্রিক রাজনীতি জমে উঠেছে, সম্ভব্য প্রার্থীরা হয়ে উঠেছেন তৎপর।

সূত্রে জানা যায়, ৩০০ নং আসনের মোট ভোটার সংখ্যা: ৩ লক্ষ ৭ হাজার ৬১৬জন। মহিলা: ১লক্ষ ৪৭ হাজার ২১৭। পুরুষ: ১লক্ষ ৬০ হাজার ৩৯৯ জন। মোট জনসংখ্যা ৪ লক্ষ, ৪ হাজার ৯৩জন। ৭টি উপজেলা ও ২টি পৌরসভা নিয়ে জেলার আয়তন : ৪ হাজার ৪শ ৭৯ দশমিক ০১। নির্বাচনী আসনের আয়তন: ৪হাজার ৪শ ৭৯ দশমিক ০১।

সূত্রে জানা যায়, ১৯৯৬ সালের সংসদ নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী হন সাচিং প্রু জেরী। পাল্টা হিসেবে রাজ পরিবারের আরেক অংশ তাঁর বিপক্ষে মাঠে নামে। ২০০১ সালে সাচিং প্রু জেরী ও মাম্যাচিং দুজনই সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামেন এবং দুজনই আওয়ামী লীগের বীর বাহাদুরের কাছে পরাজিত হন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি দলীয় মনোনয়ন পান মাম্যাচিং। তখন সাচিং প্রু নির্বাচন না করলেও পেছন থেকে কলকাঠি নাড়ার কারণে মাম্যাচিং মাত্র ৮শ ৫৩ ভোটে বীর বাহাদুরের কাছে হেরে যান।

আরো জানা যায়, ২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী হিসাবে দলের বহিষ্কৃত সাবেক সভাপতি প্রসন্ন কান্তি তংচঙ্গ্যা প্রতিদ্বন্ধিতা করলে রাজনীতির মাঠে ক্লিন ইমেজের কারনে বীর বাহাদুর পঞ্চমবারের মতো তাঁর ধারাবাহিক বিজয় অক্ষুন্ন রাখতে সক্ষম হন। কেন্দ্রিয় আওয়ামী লীগের তিনবার নির্বাচিত সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক, পার্বত্য মন্ত্রী বীর বাহাদুর এরপর থেকেই রাজনীতির মাঠে আরো সময় দিয়ে, শহর থেকে দূর্গম এলাকায় নজর কাড়া উন্নয়ন, জনগনের আরো কাছে গিয়ে নিজেকে আরো জনপ্রিয় হিসাবে জানান দেন। আর এই জনপ্রিয়তাকেই পুঁজি করে ৬ষ্ট বারের নির্বাচনে ১৭৬টি ভোটকেন্দ্রের মধ্যে নৌকা প্রতীকে আওয়ামী লীগের বীর বাহাদুর উশৈসিং পেয়েছেন ১ লাখ ৪৭ হাজার ২ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্ধী বিএনপি প্রার্থী রাজপুত্র সাচিং প্রু জেরী পেয়েছেন ৫৮ হাজার ৭১০ ভোট। বীর বাহাদুর ৮৮ হাজার ২৯২ ভোটে নির্বাচিত হয়।

আরো জানা যায়, তিন পার্বত্য জেলার (বান্দরবান, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি) মধ্যে ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি অনুযায়ী ১৯৯৮ সালে গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে খাগড়াছড়ির সাংসদ কল্পরঞ্জন চাকমাকে মন্ত্রী করা হয়েছিল। এরপর থেকে পার্বত্য জেলার সবাই ছিলেন উপমন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বে। এই প্রথম ২০১৯ সালের ৭ জানুয়ারি পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসাবে বীর বাহাদুর উশৈসিংকে এমপিকে দীর্ঘ ১৮ বছর পর পূর্ণমন্ত্রী করা হয়, মন্ত্রী হয়ে জেলার আনাচে কানাচের এমন কোন এলাকা নেই যেখানে উন্নয়নের ছোয়া লাগেনি, দূর্গম জনপদে বিদ্যুৎ, কৃষি, সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, তথ্য ও প্রযুক্তিতে উন্নয়ন দেখার মতো। তাই আগামী নির্বাচনেও জয়ী হয়ে আসতে পারেন আওয়ামী লীগের একমাত্র প্রার্থী বীর বাহাদুর।

এই ব্যাপারে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ক্যশৈহ্লা বলেন, আওয়ামী লীগের একক প্রার্থী বীর বাহাদুর, জেলায় এত বেশি উন্নয়ন কর্মকান্ড হয়েছে, এর ফলে মানুষ ফের ৭ম বারের মতো আওয়ামীলীগ প্রার্থীকে নির্বাচিত করবে।

আরো জানা গেছে, জেলা বিএনপির বর্তমান কমিটি ম্যামাচিং গ্রুপের, বান্দরবানে সাচিং প্রু জেরী বিএনপি থেকে ১৯৯৬ ও ২০০৮ সালে প্রার্থী হলেও বিদ্রোহী প্রার্থী হয় ২০০১ সালে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপির দলীয় প্রার্থী সাচিং প্রু জেরী হলেও আওয়ামী লীগ প্রার্থীর কাছে হেরে যান। দলীয় নেতাকর্মীদের চেয়ে দেশের স্বাধীনতা বিরোধী চক্র জামায়েত ইসলামীর নেতাকর্মীদের উপর অতি নির্ভরশীলতার কারনে বিএনপির মধ্যে দুই গ্রুপের দ্বন্ধ ও সংঘাত কমছে না, আর এর কারন হিসাবে সাচিং প্রু জেরীর জামায়েত প্রতিকে দায়ী করেন দলটির নেতা কর্মীরা। স্বাভাবিক ভাবে সাচিং প্রু জেরীকে কেন্দ্র থেকে মনোনয়ন দেওয়া নাও হতে পারে, অন্যদিকে লবিং এর জোর ও বর্তমান কমিটির তৃনমূলের শক্তির কারনে মাম্যাচিংও দলীয় মনোনয়ন পেলে অবাক হওয়ার কিছুই থাকবেনা। তবে বিএনপি জোটে এখন জামায়েত ইসলামী না থাকার কারনে জামায়েত এর প্রেসক্রিপশনে চলার পথ পরিহার করলে প্রবীন নেতা ও রাজ পরিবারের সদস্য হিসাবে সাচিং প্রু জেরী মনোনয়ন পেতে পারে এমন মত রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের। দলীয় মনোনয়ন যাকেই দেওয়া হোক না কেন দলের মধ্যে বিরোধীতা থাকবে। আর বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহন করলে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রার্থীর মধ্যেই মূল লড়াই হলেও দুই দলকেই এবার ভিন্ন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে। আন্ত:দ্বন্দ্ব আর কোন্দলে বান্দরবান জেলা জুঁড়ে নাজুক অবস্থার মধ্যে রয়েছে বিএনপি।

এই ব্যাপারে জেলা বিএনপি’র সাধারণ সম্পাদক জাবেদ রেজা বলেন, যদি বিএনপি নির্বাচনে যায়, তাহলে যিনি মাঠে ছিলেন এবং আছে, মামলা খেয়েছে, যিনি তৃনমূলে জনপ্রিয়, দলের সাথে বেইমানি করেনি উনাকেই দলের প্রার্থী দিবে।

সাবেক সভাপতি সাচিং প্রু জেরী আর বর্তমান সভাপতি মাম্যাচিং সমর্থকদের মধ্যে দ্বন্দ্ব এখন চরমে, সহযোগি সংগঠনগুলের তাদের পৃথক নেতৃত্বে দলীয় কর্মসূচী পালন করে। ফলে বিভক্ত হয়ে পড়ছে দলীয় নেতাকর্মীরা, নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসবে বিএনপির অভ্যন্তরিন কোন্দল তত চাঙ্গা হবে বলে মনে করছে অনেকে।

NewsDetails_03

অন্যদিকে কেন্দ্রীয় নেতাদের জেলা থেকে বার বার তাগদা দেওয়া স্বত্বেও কেন্দ্রীয় নেতারা সময় না দেওয়ার কারনে দীর্ঘ ১০ বছর ধরে জেলা সেচ্ছাসেবক লীগ ও ১৩ বছর ধরে যুবলীগের সন্মেলন না হওয়ার ফলে এই দুটি সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা নির্বাচন কেন্দ্রিক উজ্জেবিত নয়, অনেক নেতাকর্মী দায়সারা ভাবে দলের কাজ করছে, এরফলে জাতীয় নির্বাচনে এর প্রভাব পড়বে বলে মনে করছে দলটির তৃনমূল নেতাকর্মীরা।

একদিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম জন সংহতি সমিতি (জেএসএস) এর বিরোধীতা, এবার পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান, জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক কাজী মোঃ মজিবর রহমান নির্বাচনে প্রার্থী হলে, এ ক্ষেত্রে কিছুটা অস্বস্থিতে পড়বে আওয়ামী লীগ প্রার্থী বীর বাহাদুর।

জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ন সাধারণ সম্পাদক মোজাম্মেল হক বাহাদুর বলেন, নির্বাচনের অংশ হিসাবে আওয়ামী লীগ সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড তুলে ধরছে, উন্নয়নের জন্য মানুষ আওয়ামী লীগ’কে ফের জয়ী করবে, তিনি আরো বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদ থেকে কেউ নির্বাচন করলে আওয়ামী লীগের ভোট ব্যাংকে প্রভাব পড়বে না।

জেলা বিএনপির একাধিক সূত্র বলছে, জেলা বিএনপির আংশিক কমিটি নিয়ে সৃষ্টি হয় বিভক্তি। কেন্দ্রীয় কর্মসূচিগুলো আলাদাভাবে পালন করে আসছে দুই পক্ষই। এছাড়াও একে অপরকে ঘায়েল করার জন্য দুই পক্ষই বিভিন্ন সময় জড়িয়েছে সংঘাতে, এর ফলে পাল্টাপাল্টি মামলায় জর্জরিত দলটির নেতাকর্মীরা। যার কারনে জেলার রাজনীতির মাঠে অনেকটা সুবিধাজনক অবস্থানে আছে আওয়ামীলীগ। এ অবস্থা চলতে থাকলে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০০নং আসনে বিএনপির নির্বাচনী ফলাফল সন্তোষজনক হবেনা বলে মনে করছেন মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা।

আরো জানা যায়, বান্দরবান জেলা-উপজেলা জুঁড়ে এক সময় বিএনপির কর্মী, সমর্থক ছিল প্রচুর, ছাত্রদল আর যুবদল ছিল দলের মূল শক্তি। কিন্তু দলের শীর্ষ নেতাদের চরম অনৈক্য আর স্বার্থের রাজনীতির কারণে বর্তমানে তাতে ভাটা পড়েছে, যার প্রভাব পড়বে নির্বাচনের মাঠে।

বিষয়টি স্বীকার করে লামা উপজেলা বিএনপির সভাপতি মো. আমির হোসেন জানান, জেলা বিএনপিতে সমস্যা আছে, ৬ বছর ধরে পূর্ণাঙ্গ কমিটি না হওয়ার কারনে বিএনপির সাংগঠনিক দূর্বলতা কিছুটা আছে, কিন্তু সাচিং প্রু জেরীকে প্রার্থী দেওয়া হলে বিএনপি নির্বাচনে জয়ী হয়ে আসবে।

আরো জানা গেছে, বান্দরবান আসনে বিগত সময়ে জনসংহতি সমিতি থেকে প্রার্থী দেওয়া বা অন্য দলের প্রার্থীকে সমর্থন দেওয়া হলেও এবার বিভিন্ন মামলার কারনে আঞ্চলিক সংগঠনটির নেতারা আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যাওয়ায় শেষ সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক জলি মং মার্মা প্রার্থী হতে পারেন, আর তা নাহলে সংগঠনটির ভোট ব্যাংক যাবে বিএনপির দিকে। ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) থেকে আগে প্রার্থী হিসাবে ছোটন তংচঙ্গ্যাকে দেখা গেলেও সম্প্রতি সময়ে তিনি সংগঠন থেকে পদত্যাগ করে রাজনীতি ছাড়ার কারনে এবার কে প্রার্থী হচ্ছেন সেই বিষয়ে অনিশ্চিত। বান্দরবানে জামায়াতের খুব একটা সমর্থক না থাকলেও বিগত নির্বাচনগুলোতে প্রার্থী দিয়ে বা অন্য প্রার্থীর পক্ষে সমর্থন দিয়ে আওয়ামী লীগ বিরোধী একটি শক্ত প্রতিপক্ষ ছিল জামায়াতে ইসলামী, তবে সময়ের ব্যবধানে এখন জামাতের সেই অবস্থান অনেকটাই শূন্য। অন্যদিকে জোর গুঞ্জন, পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান, কাজী মোঃ মজিবর রহমান, এবারের নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারেন। জেলায় জাতীয় পার্টির দুইটি অংশের রাজনীতি সীমিত আকারে থাকলেও জেলা জাতীয় পার্টি (এরশাদ) সভাপতি ক্য শৈ অং বা সাধারণ সম্পাদক শওকত জামান মিশু নির্বাচনী প্রার্থী হতে পারেন। অন্যদিকে জাতীয় পার্টি (বিদিশা) এর সভাপতি কাজী নাসিরুল আলমকে প্রার্থী হিসাবে দেখা যেতে পারে।

এই ব্যাপারে জেলা জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক শওকত জামান মিশু জানান, দলের প্রার্থী নিয়ে সমস্যা নেই, দলের সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদকের মধ্যে একজনকে দল মনোনয়ন দিবে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি আঞ্চলিক দলটির প্রার্থী কে হচ্ছেন সেই বিষয়ে না বললেও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক জলি মং মার্মা বলেন, প্রতিটি নির্বাচনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে আমাদের প্রার্থী ছিলো, সামনেও থাকতে পারে।

বান্দরবানে ১১টি পাহাড়ি জনগোষ্ঠীসহ বাঙালীদের বসবাস। সম্প্রীতির এই জেলায় সব হিসাবে কষে আসলে কোন দল থেকে কে পাবেন দলীয় মনোনয়ন, আর প্রার্থী বা হচ্ছেন কারা, ভোটারদের মন জয় করে আগামী সংসদ নির্বাচনে কে হাসবে জয়ের হাসি, তা দেখতে অপেক্ষা করতে হবে নির্বাচন পর্যন্ত।

আরও পড়ুন