বান্দরবানে বিধ্বংসী বন্যায় ক্ষয়ক্ষতির ক্ষত

ক্ষয়ক্ষতি হাজার কোটি টাকা !

বান্দরবান পার্বত্য জেলায় ১৯৯৭ সালের পর এবার ভয়াবহ বন্যায় সরকারি ভাবে ৭০০ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতির দাবি করা হলেও বন্যায় জেলার ৭টি উপজেলার সরকারি-বেসরকারী অফিস, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ঘরবাড়ির ক্ষয়ক্ষতি হিসেব করলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমান হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করছে স্থানীয়রা।

জেলা প্রশাসনের হিসাব মতে, ১৯৯৭ সালের ১০ জুলাই এর বন্যার ২৫ বছর পর এবারের বন্যায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, বন্যায় নিহতের সংখ্যা ১০ জন ছাড়িয়ে গেছে, আহত হয়েছে শতাধিক। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৬ হাজার ৫৬৯ টি ঘর ও ১৩২টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সংখ্যা ১৬ হাজার ও আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সংখ্যা প্রায় ৪ হাজার।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য মতে, অতিবর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে এবার জেলার সাঙ্গু নদী বিপৎসীমার (১৪ দশমিক ৮) ৫ মিটার ওপর দিয়ে (অর্থাৎ ১৯ দশমিক ২৫ মিটার) প্রবাহিত হয়েছে। ১৯৯৭ সালে বিপৎসীমার সাড়ে ৫ মিটার ওপরে প্রবাহিত হয়। মাতামুহুরী নদীর পানিও বিপৎসীমার (১১ দশমিক ৮) সাড়ে ৩ মিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়, এ কারণে বন্যার ক্ষয়ক্ষতি বেশি হয়েছে।

এই বিষয়ে চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার মো: তোফায়েল ইসলাম বান্দরবানের সফর কালে বলেন, বান্দরবানে বন্যায় ২ হাজার কিলোমিটার রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে প্রায় ১০০কোটি টাকার মত ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট ব্যবস্থা ঃ-
বন্যার পর জেলায় ইন্টারনেট ব্যবস্থার ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হলেও স্বাভাবিক হয়। থানচি ও রুমা উপজেলায় বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবন্থা ভেঙ্গে পড়ে, সেখানে এখনো অন্ধকারে স্থানীয়রা। বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে দিনে রাতে কাজ করছে বিদ্যুৎ বিভাগ।

বান্দরবান বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সৈয়দ আমির হোসেন বলেন, বন্যার কারনে সঞ্চালন লাইন নষ্ট হয়েছে, বৈদ্যুতিক পিলার ভেঙ্গে পড়েছে, সাব স্টেশন পানিতে তলিয়ে যাওয়ার কারনে ট্রান্সফরমার নষ্ট হয়ে গেছে, জেলা ও উপজেলার বিদ্যুৎ অফিস পানিতে তলিয়ে যাওয়ার কারনে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, ক্ষতির পরিমান শত কোটি টাকা হতে পারে।

কৃষি বিভাগের যত ক্ষতিঃ-
জেলা কৃষি বিভাগের উপ-পরিচালক (শস্য) হাসান আলী জানান, বন্যায় জেলার ৭১ হাজার চাষির ৮ হাজার ৮৫৩ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে, ক্ষতির পরিমাণ ৩১০ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। ক্ষতিগ্রস্ত ফসলের মধ্যে রয়েছে আমন ও রোপা ধানের বীজতলা, কলা, পেঁপে, কাজু বাদাম, জুম চাষ ও সবজি।

সড়ক ও যোগাযোগ ব্যবস্থাঃ-
বান্দরবানের থানচি সড়কের মিলনছড়ি থেকে চিম্বুক-নীলগিরি সড়কের পোড়া বাংলা ও পাথুইপাড়াসহ বিভিন্ন সড়ক ধসে নিচে নেমে যাওয়া অনেকে দেখে আঁতকে উঠছে। জেলার সাথে থানচি ও রুমা উপজেলার সড়ক যোগাযোগ এখন বন্ধ থাকায় উপজেলাগুলোতে যোগাযোগের মাধ্যম এখন নৌপথ। সড়ক মেরামত করে চালু করতে এক মাস সময় লেগে যেতে পারে।

NewsDetails_03

পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী ইয়াসির আরাফাত জানান, জেলার ৪২ টি সড়কের ১২৭ কিলোমিটার ২২ কিলোমিটার সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যার আর্থিক ক্ষতি ৪২ কোটি টাকা।

বান্দরবানের স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জিয়াউল ইসলাম মজুমদার জানান, জেলার ৯০০ কিলোমিটার সড়কের মধ্যে ৩০০ কিলোমিটার সড়ক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সড়কগুলো সংস্কার করতে প্রায় ১৫০ কোটি টাকা প্রয়োজন। বরাদ্দ পেলেই এসব সড়কের সংস্কার কাজ দ্রুত শুরু করা হবে।

সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মোসলেহ উদ্দিন জানান, জেলায় ৪৬০ কিলোমিটার সড়কপথ রয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী (ইসিবি) তত্ত্ববধানে থাকা ১৮১ কিলোমিটার সড়কের মধ্যে ৫০ কিলোমিটার সড়কের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। যার ক্ষতির পরিমাণ ৩০ কোটি টাকা। বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়া সড়কের স্থানগুলো উঁচুকরণ, ২১টি ব্রিজ, ১৫টি কালভার্ট, ২১ কিলোমিটার ড্রেনেজ নিষ্কাশন অবকাঠামোসহ ২৩ কিলোমিটার জেলার প্রধান সড়ক বান্দরবান-কেরানিহাট মহাসড়ক ২৬৬ কোটি ৫৬ লাখ টাকা ব্যায়ে নির্মাণ করা হয়, এই মহাসড়কের অনেক স্থান বিধস্ত হয়েছে।

মৎস্য বিভাগের ক্ষয়ক্ষতিঃ-
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা অভিজিত শীল জানান, মৎস্য বিভাগের ৪৩০টি জলাশয় ও বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ করা ১৬০টি প্রকল্প ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যার ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৩ কোটি টাকা। তিনি বলেন, ১৫০টি জলাশয় ও ৩০টি লেক ভেসে গেছে লামা উপজেলায়।

জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস জানায়, জেলার ১২৭টি প্রাথমিক বিদ্যালয় ডুবে যাওয়ায় ১ কোটি ৩৯ লাখ ৬৫ হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে। কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের অবহেলার কারণে জেলা গণগ্রন্থাগারের ২৮ হাজার বই ও অফিসের যাবতীয় নথিপত্রসহ সবকিছুই নষ্ট হয়ে যায়। তাছাড়া অনেক সরকারি-বেসরকারী মাধ্যমিক বিদ্যালয় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

পর্যটন খাতঃ-
বান্দরবানের রুমা ও থানচি উপজেলার প্রধান সড়ক ধসে যাওয়ার কারনে ও হোটেল-মোটেলগুলো পানিতে তলিয়ে যাওয়ার কারনে পর্যটনশিল্পের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এখনো রুমা ও থানচি উপজেলার সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে।

হোটেল মোটেল রিসোর্ট মালিক সমিতির অর্থ সম্পাদক রাজীব বড়–য়া জানান, বন্যায় হোটেল -মোটেল ডুবে গেছে ও পর্যটনস্পটে যাওয়ার সড়ক ভেঙ্গে যাওয়ার কারনে জেলা সদর, রুমা ও থানচির পর্যটনকেন্দ্রগুলো এবং হোটেল রিসোর্টও ফাঁকা পড়ে আছে। পর্যটকবাহী পাঁচ শতাধিক গাড়ি, হোটেল মোটেলের শ্রমিক, পর্যটক গাইড বেকার হয়ে আছে।

প্রসঙ্গত,নির্বিচারে পাহাড় নিধন ও বনজঙ্গল উজার, পাহাড়ের মাটিতে সাঙ্গু ও মাতামুহুরি নদীর তলদেশ ভরাট এবং কৃষি জমি ভরাট করে সাতকানিয়া- দোহাজারি কক্সবাজার রেললাইন নির্মানে পর্যাপ্ত ব্রিজ,কালভার্ট না থাকায় পানি নিস্কাসন না হওয়ায় ভয়াবহ বন্যার শিকার হয় বান্দরবানের মানুষ।

আরও পড়ুন